দীর্ঘ ৫৪ বছরের স্বাধীনতার পথচলায় বাংলাদেশ একদিকে অগ্রগতির উদাহরণ স্থাপন করেছে, অন্যদিকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকার হতাশাজনক বাস্তবতাও স্পষ্ট। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আজকের এই উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠে আসা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। তবে এ অগ্রগতির পথে আমরা যেসব চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করেছি, তার চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে আমাদের কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে। বিশেষত, নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রশ্নে দেশের অর্জনগুলোর টেকসই হওয়া নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
অর্থনীতির সাফল্যের গল্প
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য আজ সারা বিশ্বে আলোচিত। তৈরি পোশাক শিল্পে দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ একটি শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে। গ্রামীণ অর্থনীতি রেমিট্যান্সের মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয়েছে এবং দারিদর্্েযর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো বৃহৎ অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে।
তবু এই সাফল্যের মাঝেও আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামোতে বড় ধরনের দুর্বলতা রয়ে গেছে। দেশের ধনী-গরিবের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, যুব সমাজের উচ্চ বেকারত্ব, এবং ক্রমবর্ধমান ঋণনির্ভর উন্নয়ন আমাদের অগ্রগতির স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলে।
রাজনৈতিক চর্চার দুষ্টচক্র থেকে মুক্ত হতে হবে
রাজনীতি সবসময়ই বাংলাদেশের উন্নয়নের কেন্দ্রে ছিল। কিন্তু এটি যেমন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, তেমনি গত পাঁচ দশকের বেশিরভাগ সময় তা বিভেদ, সহিংসতা, এবং গণতন্ত্রের সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতিবিদদের কাছে জনস্বার্থ যেন প্রায়শই উপেক্ষিত একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণতন্ত্রের নামে ক্ষমতা দখলের লড়াই, নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থার অভাব, এবং বিরোধী মতের দমনের প্রবণতা দেশের রাজনীতিকে সংকুচিত করে ফেলেছে।
বড় রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়শই মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসকে নিজেদের রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। জাতির গৌরবকে দলীয় সম্পত্তি বানিয়ে ফেলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধ আপামর জনতার গর্ব না হয়ে দলীয় রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। ইতিহাসের এই দলীয়করণ জাতীয় ঐক্যের বদলে বিভাজন তৈরি করেছে।
সমাজ ও শিক্ষা: প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন কোথায়?
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নে যথেষ্ট উন্নতি করেছে। তবে মানসম্মত শিক্ষা এবং দক্ষতা বিকাশে এখনও অনেক পিছিয়ে আছি। শিক্ষিত যুব সমাজের মধ্যে বেকারত্ব একটি গভীর সংকট, যা শুধুমাত্র আর্থিক নয়, সামাজিক অস্থিরতার কারণও হতে পারে।
সামাজিক মূল্যবোধেও অবক্ষয় চোখে পড়ে। দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার কেবল অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক উন্নয়নকেও বাধাগ্রস্ত করেছে। একশ্রেণির ক্ষমতাধরদের প্রতি আইনের শৈথিল্য এবং সাধারণ মানুষের প্রতি ন্যায়বিচারের অভাব জাতির মনোবল দুর্বল করছে।
পরিবেশ ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। নানান দূর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এই দেশটি আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করলেও অভ্যন্তরীণ পরিবেশ দূষণ, অপরিকল্পিত নগরায়ন, এবং বন উজাড়ের মতো সমস্যাগুলো সমাধানে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। শহরগুলোতে বায়ু দূষণ ও পানির সংকট একটি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা এবং মুক্তির পথ
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ যেমন জাতির আত্মপরিচয়ের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল, তেমনি ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থান গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশি বাঙালির চেতনাকে নতুন করে জাগ্রত করেছে। এই চেতনার মূল ভিত্তি ছিল জনগণের অংশগ্রহণ, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ঐক্য, এবং গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা।
আজকের বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় এই চেতনা নতুন করে প্রাসঙ্গিক। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি এই অভ্যুত্থানের মূল্যবোধ থেকে শিক্ষা নেয়, তবে জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। শাসনব্যবস্থায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা বারবার আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ছাড়া উন্নয়ন কখনোই স্থায়ী হতে পারে না।
ভবিষ্যতের ভাবনায় সুশাসনের বিকল্প কোথায়
৫৪ বছরে বাংলাদেশ অনেক দূর এসেছে। তবে এ যাত্রা আরও অনেকদূর যাওয়ার বাকি। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি টেকসই করতে হলে দরকার সুশাসন, ন্যায়বিচার, এবং সমতাভিত্তিক উন্নয়ন। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের স্বার্থে কাজ করতে হবে।
দেশের তরুণ প্রজন্ম এখন সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা। তবে তাদের সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে হলে দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার দূর করতে হবে। রাজনীতির পরিবেশ গণতান্ত্রিক এবং স্বচ্ছ না হলে আমাদের অর্জনগুলো শুধু তাৎক্ষণিক সাফল্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
বাংলাদেশের ৫৪ বছরের ইতিহাস আমাদের শেখায় যে আমরা অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারি। তবে সেই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে আমাদের নেতৃত্ব, প্রতিষ্ঠান, এবং জনগণের মধ্যে আস্থা পুনঃস্থাপন করতে হবে। সোনার বাংলাদেশ যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, তেমনই এক ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবেই একটি উন্নত, সমৃদ্ধ, এবং সুশাসিত ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে হবে।
লেখক
সাকিবুর রহমান
সাংবাদিক ও শিক্ষার্থী