রাজধানীতে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে গত শনিবার জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ আয়োজিত নাগরিক সমাবেশে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে গণঅধিকার পরিষদের মুখপাত্র ফারুক হাসানসহ জাতীয় বিপ্লবী পরিষদের বেশ কয়েকজন আহত হন।
তবে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে গণঅধিকার পরিষদের নেতা ফারুক হাসানের ওপর কোনো হামলা হয়নি বলে দাবি করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের একটি পক্ষ; যারা এই হামলার সঙ্গে জড়িত বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। হামলায় অংশ নেওয়া কয়েকজনের ছবি ইতোমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে।
রোববার জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের দোতলায় সংবাদ সম্মেলন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের ওই পক্ষটি বলে, গত শনিবার জাতীয় বিপ্লবী পরিষদ আয়োজিত নাগরিক সমাবেশে আমন্ত্রিত হয়ে তারা অংশ নেন। ওই অনুষ্ঠানে গণঅধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সহসভাপতি ফারুক হাসানও আমন্ত্রিত ছিলেন। সেখানে ফারুক হাসানের সঙ্গে তাদের একটি ‘অপ্রীতিকর’ ঘটনা ঘটে।
তাদের দাবি, শহিদ মিনারে এক সমাবেশে ফারুক হাসান অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে কটূক্তি করেন। ফারুক হাসানকে তার বক্তব্য প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়েছিলেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত একজন। এ নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে ‘হাতাহাতি’ হয়। তবে গণঅধিকার পরিষদ ঘটনাস্থলে থাকা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত কয়েকজনকে রাজনৈতিক ‘ট্যাগ’ দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার চালাচ্ছে।
গণঅধিকার পরিষদের নেতা ফারুক হাসানের ওপর কোনো হামলা হয়নি বলে দাবি করে গতকাল রোববার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের একটি পক্ষ সংবাদ সম্মেলন করে; এদের মধ্যে হামলায় অংশ নেওয়া (গোল চিহ্নিত) মোহাম্মদ আবীর আহমেদ শরীফ, কোরবান শেখ হিল্লোল ও সাইফুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে কোরবান শেখ হিল্লোল নামের একজন বলেন, শহিদ মিনারের ওই অনুষ্ঠানে আহতদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তাদের বলা হয়েছিল, ওই অনুষ্ঠানে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নিহত ও আহতদের নিয়ে কথা হবে। কিন্তু ফারুক হাসান সরকারের সমালোচনা করে বক্তব্য দেন। রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে কটূক্তি করেন। ফারুক হাসানকে রাজনৈতিক বক্তব্য না দেওয়ার জন্য সাইফুল ইসলাম নামে একজন অনুরোধ জানান। পাশাপাশি রাজনৈতিক বক্তব্য প্রত্যাহারের জন্য ফারুক হাসানকে অনুরোধ করেন সাইফুল ইসলাম। এ সময় ফারুক হাসানসহ গণঅধিকার পরিষদের কয়েকজন সাইফুল ইসলামকে মঞ্চের পেছনে নিয়ে যান। তারপর আন্দোলনে আগত কয়েকজন এগিয়ে এলে উভয় পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি হয়। এ ঘটনাকে গণঅধিকার পরিষদ রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করছে।
তিনি আরও বলেন, গণঅধিকার পরিষদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি দিয়ে বলছে, এরা হামলাকারী। এরা দুষ্কৃতকারী, এদের ধরিয়ে দেন। তারা নানা ধরনের উদ্দেশ্যমূলক কথা বলছেন, রাজনৈতিক ‘ট্যাগ’ দিচ্ছেন। এখন সাধারণ মানুষ তো আমাদের চেনেন না। তারা যদি আমাদের ওপর হামলা করেন, এর দায়ভার কে নেবে? আহতদের কোনো দল নেই। আহতদের নিয়ে বাণিজ্য করবেন না, ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করবেন না।
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই বক্তব্য দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত মোহাম্মদ আবীর আহমেদ শরীফ। শহিদ মিনারের সমাবেশে তিনিও অংশ নেন। মোহাম্মদ আবীর আহমেদ বলেন, গতকাল শহিদ মিনারে ফারুক হাসানের ওপর কোনো হামলা হয়নি। তিনি পড়ে গিয়ে হয়তো আহত হয়েছেন। গণঅধিকার পরিষদ প্রচার চালাচ্ছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতরা নাকি গতকালের অনুষ্ঠানে ছুরি নিয়ে গেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন পেজ থেকে বলা হচ্ছে, ‘আমরা নাকি সন্ত্রাসী।
এদিকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতদের পক্ষে সংবাদ সম্মেলনে কোরবান শেখ হিল্লোল ও মোহাম্মদ আবীর আহমেদ শরীফ নামে যে দুজন বক্তব্য দিয়েছেন তাদেরকে শহিদ মিনারের হামলায় অংশ নিতে দেখা গেছে। তাদের ছবি ইতোমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। এছাড়া সংবাদ সম্মেলনে সাইফুল ইসলাম নামে যে ব্যক্তিকে দেখা গেছে; ফারুক হাসানকে হামলার আগমুহূর্তে স্টেজের পাশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে দেখা গেছে তাকে।
প্রসঙ্গত ফারুক হাসান জাতীয় বিপ্লবী পরিষদের আয়োজনে শহিদ মিনারে আয়োজিত নাগরিক সমাবেশে বিশেষ অতিথি ছিলেন। সেখানে দেওয়া বক্তব্যে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর বিপ্লবী সরকার না হওয়ার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে অভিযুক্ত করার পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারের নানা সমালোচনা করেন তিনি।
প্রত্যক্ষদর্শী এক সাংবাদিক বলেন, ফারুক হাসানের বক্তব্যের একপর্যায়ে তার দিকে তেড়ে আসেন মোহাম্মদ আবীর আহমেদ শরীফ। মঞ্চের ডান পাশ থেকেও সাইফুল ইসলামের নামের ব্যক্তি ফারুক হাসানকে বক্তব্য বন্ধ করতে হুমকি ধমকি দেন এবং সেখানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন। তখন তাদেরকে সরিয়ে দেয় জাতীয় বিপ্লবী পরিষদের নেতাকর্মীরা।
হামলার ঘটনার বর্ণনা করে ওই গণমাধ্যমকর্মী আরও বলেন, ফারুক হাসান বক্তব্য শেষ করে মঞ্চে এসে শহিদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে গিয়ে বসেন। আধা ঘণ্টা পর ফারুক হাসান চারজন সঙ্গীসহ সভাস্থল ত্যাগ করে চলে যান। তখন আবীর আহমেদ শরীফের নেতৃত্বে হামলা করা হয়।এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন হিল্লোলসহ আরও অনেকে। হামলার শুরুতে ফারুকের সঙ্গে থাকা চারজন সরে যান। এসময় হামলা থেকে ফারুক হাসানকে রক্ষা করতে জাতীয় বিপ্লবী পরিষদের ১৫ জনের মতো নেতাকর্মী এগিয়ে যান।
প্রত্যক্ষদর্শী গণমাধ্যমকর্মী জানান, হামলাকারীদের মারধরে জাতীয় বিপ্লবী পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক সাইয়েদ কুতুব, বিপ্লবী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সহকারী সদস্য সচিব আশরাফুল ইসলাম ও এস এম রাফসানযানি, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক মো. আরিফুল ইসলাম সাকিব, সলিমউল্লাহ ও হিযবুল্লাহ আহত হয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, হামলায় অংশ নেওয়া তরুণরা ২৫ থেকে ৩০ জন ছিলেন, তাদেরকে দেখে আহত মনে হয়নি। তারা ফারুক হাসানকে রক্ষা করতে যাওয়া নেতাকর্মীদের ওপরও চড়াও হয়। এ সময় সমাবেশস্থলের ৩০টিরও বেশি চেয়ারও ভাঙচুর করেন হামলাকারীরা। এরপর ফারুককে ধাওয়া দিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল অভিমুখী সড়ক পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও তাকে মারধর করা হয়।
হামলার পর একটি ভিডিও বার্তায় ফারুক হাসান বলেন, জাতীয় বিপ্লবী পরিষদের সমাবেশে তিনি তার রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন। সেখানে ছাত্রদলের ‘সন্ত্রাসীরা’ উপস্থিত ছিল। সমাবেশে তার বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা তার ওপর অতর্কিত আক্রমণ করেছে। তার মানিব্যাগ ও মোবাইল ফোনও ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। ভিডিও বার্তায় কারও নাম উল্লেখ করেননি ফারুক হাসান।
হামলার পর গণঅধিকার পরিষদের রাশেদ খান জানান, গণঅভ্যুত্থানে এই আহত ছেলেরাই ( শরীফ ও হিল্লোল) ফারুক হাসানের ওপর বর্বর হামলা করেছে। এরা আজকে রাতেও জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান হাসপাতালে আছে। গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন! এই ছেলেগুলো কেন ফারুক হাসানের ওপর হামলা করলো, নেপথ্যে কারণ জানা জরুরি। বড় ধরনের ষড়যন্ত্র আছে বলে ধারণা করছি। গোয়েন্দা সংস্থাকে সবকিছু অনুসন্ধান করতে হবে।
অপরদিকে জাতীয় বিপ্লবী পরিষদের আহ্বায়ক খোমেনী ইহসান বলেছেন, ফারুক হাসানের ওপর যারা হামলা করেছে তাদের সবার ভিডিও ফুটেজ আছে এবং তাদের পরিচয়ও উন্মোচিত হয়েছে। এখন তাদেরকে গ্রেফতার করা সরকারের দায়িত্ব। বিশেষ করে তিন ছাত্র উপদেষ্টার দায়িত্ব হলো হামলাকারীদের গ্রেফতার নিশ্চিত করা। তাহলে তাদের সংস্কারের বিশ্বাস যোগ্যতা তৈরি হবে। এক্ষেত্রে পুরো ঘটনা সংঘটনে সারজিস আলমের ভূমিকার বিষয়েও তিন ছাত্র উপদেষ্টার অবস্থান স্পষ্ট হওয়া দরকার।
তিনি আরও বলেন, বিপ্লবী পরিষদ নতুন বলে তারা হামলার ইস্যু ইগনোর করতে পারে। কিন্তু বিএনপির রাজনীতির সামনে তাদের দাঁড়াতে না পারার কারণগুলোর মধ্যে এই হামলা বারবার প্রাসঙ্গিক হবে। একটি নতুন দলের প্রতি সরকারের ছাত্র অংশের ভূমিকা চরম ফ্যাসিবাদী। এ অবস্থায় ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপে তাদের বয়ানের ন্যায্যতা শেষ হয়ে গেছে।