রহস্যের শেষ নেই এই পৃথিবীতে। এখানে নানা রহস্যময় ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত, আবিষ্কৃত হচ্ছে বহু রহস্যময় এবং চমকপ্রদ স্থান ও বস্তু, যা কখনো কখনো আমাদেরকে অবাক করছে, আবার কখনো করছে মুগ্ধ! প্রকৃতির আশ্চর্যজনক এসব ঘটনার কোনো কোনোটির ব্যাখ্যা আমরা খুঁজে পেয়েছি, আবার কিছু ঘটনা আজো হয়তো ব্যাখ্যাতীত। চলুন আজকে দেখে নিই এমনই অদ্ভুত ও বিস্ময়কর প্রাকৃতিক ঘটনা, স্থান ও বস্তু।
চীনের রহস্যময় ফেনা
২০১৩ সালের একটি রাত। স্থান চীনের নানজিং শহর। রাতের শহুরে রাস্তায় যাতায়াত করছিলেন পথচারীরা। এমন সময় হঠাৎ করেই রাস্তার মাঝের একটি ফাটল থেকে গলগল করে বেরিয়ে আসতে থাকে সাদা দুর্গন্ধময় ফেনা। তবে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই আবার একই ১ সেন্টিমিটার ফাটল দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় সেই বিশাল দানবীয় ফেনার কুণ্ডলী! ঘটনার আকস্মিকতায় থমকে যায় আশেপাশের সবাই। পরবর্তীতে ঘটনার তদন্তে এর কোনো ব্যাখ্যাই খুঁজে বের করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। তবে সরকারিভাবে বলা হয়, রহস্যময় এই ফেনা হয়তো কাছাকাছি নির্মাণাধীন একটি পাতাল পথ থেকেই বের হয়েছে। তবে এটি বিশ্বাস করেন না অনেকেই।
সাদা ট্রেইলের কালো ফাটল
ক্যানিয়ন ল্যান্ড ন্যাশনাল পার্কের ‘দ্য ব্ল্যাক ক্র্যাক’ নামে পরিচিত ফাটলটি হলো একটি প্রাকৃতিক ভূপৃষ্ঠ ফাটল। ভয়ঙ্কর চেহারার এই ফাটলটি একসময় স্থানীয় রাখাল ও খনি শ্রমিকরা নিচের দিকে নামার জন্য ব্যবহার করতো। এর ভেতরে একটি তাকও রয়েছে, যেখানে প্রস্তর যুগের বহু চকমকি পাথর দেখতে পাওয়া যায়। বর্তমানে এ স্থানটি দেশ বিদেশের বহু পর্যটককে আকর্ষণ করে। বিশ্বের বহু দেশ থেকে বহু পর্যটক প্রাকৃতিক এই ফাটলটি দেখতে আসেন প্রতিনিয়ত।
আলোক বিচ্ছুরিত সমুদ্রসৈকত
সমুদ্রের পানিতে ফসফরাসের উপস্থিতির ফলে সমুদ্রের ফেনা রাতে জ্বলজ্বল করে, এ তথ্য আমরা অনেকেই জানি। তবে ২০১৫ সালে হংকংয়ের একটি সমুদ্র সৈকতে দেখা যায় এক চমকপ্রদ দৃশ্য। রাতের আঁধারে সমুদ্রের পানি থেকে নীলচে এক আভা বের হতে থাকে হঠাৎ করেই। পরবর্তীতে জানা যায়, নিকটবর্তী একটি খামারের দূষণের ফলে সমুদ্রের পানিতে একটি বিশেষ অনুজীব ছড়িয়ে পড়ে, যারা পানিতে আলোর বিচ্ছুরণ ঘটায়। আর তার ফলেই সৃষ্টি হয় এই অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্যের।
চীনের রংধনু পাহাড়
যদি কখনো এই ভেবে অবাক হন যে, মানুষ কিভাবে রং-বেরংয়ের ছবি আঁকার অনুপ্রেরণা পেয়েছিল, তবে আপনাকে যেতে হবে চীনের ‘ঝানগাই ডানজিয়া ল্যান্ডফর্ম’ পার্কে। এই পার্কেই অবস্থিত বিস্ময়কর ও অদ্ভুত সুন্দর রংধনু পাহাড়। ২০০৯ সালে ‘ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইট’ হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এই পাহাড়টি প্রাকৃতিকভাবেই নানা রংয়ে রঙিন। নানা খনিজ পদার্থ, আয়রন অক্সাইড প্রভৃতির উপস্থিতির ফলেই পাহাড়টি এমন রং ধারণ করেছে।
পোল্যান্ডের বাঁকা বন
বনটিতে প্রবেশ করলে প্রথম দর্শনেই আপনার মনে হতে পারে, আপনি হয়তো কোনো রূপকথার জাদুর বনে প্রবেশ করেছেন। কারণ ১৯৩০ সালে লাগানো এই বনের প্রায় ৪০০টি পাইন গাছের সবগুলো গাছই উত্তর দিকে বাঁকানো! দেখে মনে হবে কোনো এক জাদুমন্ত্রের প্রভাবে বনের সমস্ত গাছ একদিকে বেঁকে গেছে। অদ্ভুত দর্শন এই বনের অবস্থান পোল্যান্ডের গ্রাইফিনোতে। কেন এই বনের সব গাছ উত্তর দিকে বেঁকে গেছে, তা আজও রহস্য।
রক্তের ঝর্ণা
ঠান্ডা বরফে ঢাকা অ্যান্টার্কটিকা বহুকাল ধরেই মানুষের কাছে নানা রহস্যের কেন্দ্রবিন্দু। এখানে রয়েছে এক অদ্ভুত ঝর্ণা, যা থেকে পানি ঝরে না, ঝরে ‘রক্ত’! অস্ট্রেলিয়ান ভূবিজ্ঞানী গ্রিফিথ টেইলর সর্বপ্রথম ১৯১১ সালে এই ঝর্ণাটি আবিষ্কার করেন। তবে আপাতদৃষ্টিতে রক্ত বলে মনে হলেও এটি আসলে রক্ত নয়। এই ঝর্ণার নোনা পানিতে জারিত লৌহের উপস্থিতির কারণে এই পানি রক্তের মতো দেখায়। ঠিক যেভাবে লোহায় মরিচা পড়লে লোহা লালচে হয়ে যায় এই ঝর্ণার পানিও সেভাবেই রক্তের মতো লাল দেখায়।
নীল আগ্নেয়গিরি
আগ্নেয়গিরির লাভার রং কমলা থেকে লাল হয় বলেই আমরা জানি। তবে ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব জাভায় অবস্থিত আইজেন আগ্নেয়গিরির লাভা নীল! অদ্ভুত সুন্দর এই আগ্নেয়গিরির লাভার রং বরফের মতো নীলচে হলেও এটি মোটেও ঠাণ্ডা নয়। ব্যতিক্রমী এই আগ্নেয়গিরিতে প্রায় ৩৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সালফিউরিক গ্যাসের দহন হচ্ছে সবসময়। আর এই গ্যাসগুলো বাতাসের সংস্পর্শে এসেই এই নীল রংয়ের আগুনের সৃষ্টি করছে। ঠিক যেমন আগুন আমরা দেখি আমাদের বাসার গ্যাসের চুলায়।
জীবিত পাথর
দেখে মনে হবে এটি একটি পাথর। কিন্তু পাথর কি কখনো জীবিত হয়? অদ্ভুত এই পাথরটি মাঝ থেকে কাটলে বের হয়ে আসবে রক্ত! দেখতে পাথরের মতো হলেও এটি আসলে Pyura Chilensis নামের একটি সামুদ্রিক প্রাণী। পেরু এবং চিলিতে এই জীবন্ত পাথর দেখতে পাওয়া যায়। মজাদার স্বাদের কারণে স্থানীয় মানুষের খুব প্রিয় একটি খাবার এটি। সমুদ্রের তলদেশে ফিল্টার হিসেবে কাজ করে এই সামুদ্রিক প্রাণীটি। শুধু তা-ই নয়, এই প্রাণীর রক্তে পাওয়া যায় দুর্লভ ভ্যানাডিয়াম ধাতু!
সমুদ্রের নিচের ঝর্ণা
সাধারণত পাহাড়ি এলাকায় কিংবা ভূপৃষ্ঠে আমরা ঝর্ণা দেখতে পাই। কিন্তু সমুদ্রের নিচে ঝর্ণা কি সম্ভব? হ্যাঁ, এমনই একটি ঝর্ণা অবস্থিত মাউরিটাসে। সমুদ্রের নিচের এই অনিন্দ্যসুন্দর ও রহস্যময় ঝর্ণাটিকে দেখে মনে হবে এখানে সবসময় নিচের দিকে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। তবে পানির নিচের এই ঝর্ণাটি আসলে একটি দৃষ্টিভ্রম। এখানে পানি নয়, বরং আশেপাশের সমুদ্র সৈকতের বালি সমুদ্রের পানির সাথে ধুয়ে এসে নিচে পড়ছে, যা দেখে পানির মতো মনে হয়। তবে যা-ই হোক না কেন, অদ্ভুত সুন্দর এই ঝর্ণা আপনাকে অবশ্যই মুগ্ধ করবে!
কেরালার রক্তবৃষ্টি
২০০১ সালে ভারতের দক্ষিণের রাজ্য কেরালায় ঘটে এক অদ্ভুত ঘটনা। আকাশ থেকে নেমে আশে বৃষ্টি, তবে তার রং লাল, ঠিক রক্তের মতো! লাল রংয়ের এই বৃষ্টিতে আশেপাশের সবার জামাকাপড় গোলাপি রং ধারণ করে। অদ্ভুত এই বৃষ্টির কারণ হিসেবে প্রথমে উল্কাপাতকে দায়ী করা হয়। তবে পরবর্তীতে গবেষণায় জানা যায়, Trentepohlia গোত্রের একটি বিশেষ ছত্রাকের উপস্থিতির কারণে বৃষ্টির পানি এমন লাল রং ধারণ করেছিল।
মরুভূমির গোলাপ
জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী স্ট্রিংয়ের ‘ডেজার্ট রোজ’ গানটি হয়তো অনেকেরই শোনা। তবে শুধু এই গানেই নয়, বরং বাস্তবেও কিন্তু মরুভূমির গোলাপ বা ‘ডেজার্ট রোজ’ রয়েছে। গোলাপের মতো দেখতে এই বস্তুটি আসলে জিপসামের তৈরী একটি প্রাকৃতিক স্ফটিক। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালির কণা নিয়ে গঠিত হয় এই মরুভূমির গোলাপ। পাথরের এই গোলাপ ছোট থেকে শুরু করে বিশাল আকারের হতে পারে। খুঁজে পাওয়া সবচেয়ে বিশাল গোলাপটি ছিল ৯৯ সেন্টিমিটার লম্বা ও ওজনে প্রায় ৪৫৪ কিলোগ্রাম!