বাংলাদেশের প্রযুক্তি নির্ভর অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রেক্ষিতে “পেপারলেস” বা কাগজবিহীন সমাজ গঠনের হতে পারে অত্যন্ত সময়োপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ একটি উদ্যোগ। এই পদক্ষেপ দেশের প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা, দ্রুততা এবং পরিবেশবান্ধবতা নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে। তবে, এই লক্ষ্য অর্জনে নির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক।
ডিজিটালাইজেশন ও ইনফ্রাস্ট্রাকচার উন্নয়ন
পেপারলেস সমাজ গঠনের প্রথম এবং প্রধান পদক্ষেপ হলো দেশের সমস্ত প্রশাসনিক ও আর্থিক কার্যক্রম ডিজিটালাইজ করা। এ লক্ষ্যে, সরকারি ও বেসরকারি সেক্টরে ই-গভর্নেন্স ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। বিভিন্ন সরকারি দফতরে ডিজিটাল রেকর্ডিং এবং ডকুমেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালু করতে হবে। এছাড়া, ইন্টারনেট অবকাঠামোর উন্নয়ন এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলেও উচ্চ গতির ইন্টারনেট সুবিধা পৌঁছে দিতে হবে।
আইনি ও নীতিগত সহায়তা
পেপারলেস বাংলাদেশ গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় আইনি ও নীতিগত কাঠামো গড়ে তোলা জরুরি। সরকারকে ডিজিটাল ডকুমেন্টের বৈধতা প্রদান এবং সাইবার সিকিউরিটি নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করতে হবে। এছাড়া, ই-সিগনেচার এবং ডিজিটাল আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম প্রবর্তন করতে হবে, যাতে ডিজিটাল ডকুমেন্টের গ্রহণযোগ্যতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।
প্রশিক্ষণ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি
পেপারলেস সমাজ গঠনের জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। সরকারি কর্মচারী, বেসরকারি খাতের কর্মী এবং সাধারণ জনগণকে ডিজিটাল সিস্টেম ব্যবহারে দক্ষ করে তোলার জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি আয়োজন করতে হবে। এর মাধ্যমে কাগজের ব্যবহার কমিয়ে ডিজিটাল সিস্টেমের প্রতি তাদের আস্থা বাড়ানো সম্ভব হবে।
ই-গভর্নেন্স ও ই-সেবা
সরকারকে ই-গভর্নেন্স এবং ই-সেবা ব্যবস্থার প্রসারে উদ্যোগী হতে হবে। বিভিন্ন সরকারি সেবা যেমন, জমি রেজিস্ট্রেশন, কর প্রদান, পাসপোর্ট আবেদন ইত্যাদি ডিজিটালাইজ করা উচিত। এতে করে জনগণ সহজেই এবং দ্রুততার সাথে তাদের প্রয়োজনীয় সেবা পেতে পারবে। এ উদ্যোগ দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে সহায়তা করবে।
পরিবেশ সুরক্ষা ও টেকসই উন্নয়ন
কাগজবিহীন সমাজ গঠনের মাধ্যমে পরিবেশেরও সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব। কাগজের ব্যবহার কমিয়ে আমরা গাছের সংখ্যা সংরক্ষণ করতে পারি, যা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করবে। তাছাড়া, ডিজিটাল ডকুমেন্ট ব্যবস্থার মাধ্যমে শক্তি ও সম্পদের অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে, যা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়তা করবে।
জনসাধারণের অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা
জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা পেপারলেস সমাজ গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনগণকে ডিজিটাল পদ্ধতির সুবিধা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে এবং তাদের উৎসাহিত করতে হবে। বিভিন্ন প্রচার ও প্রচারণার মাধ্যমে জনমনে ডিজিটালাইজেশনের গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে।
সম্ভাব্য বাধা এবং চ্যালেঞ্জ
১. প্রাথমিক বিনিয়োগের অভাব: ডিজিটাল সিস্টেম স্থাপন ও পরিচালনায় প্রাথমিক বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। অনেক সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এই বিনিয়োগে সাড়া দিতে অনীহা প্রকাশ করতে পারে।
২. প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাব: দেশের একটি বড় অংশের জনগণ এখনও প্রযুক্তিগতভাবে স্বল্প দক্ষ। ফলে ডিজিটাল পদ্ধতি গ্রহণ ও ব্যবহারে অসুবিধা হতে পারে।
৩. সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকি: ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়ায় সাইবার নিরাপত্তা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তথ্য হ্যাকিং, ডেটা চুরি ইত্যাদি ঝুঁকি রয়েছে, যা মোকাবিলায় কার্যকর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৪. পরিবর্তন প্রতিরোধ: অনেক প্রতিষ্ঠান ও কর্মী পরিবর্তন গ্রহণে অনীহা দেখাতে পারে। তারা কাগজের পদ্ধতিতে কাজ করতে অভ্যস্ত এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে পরিবর্তন মানসিকভাবে প্রস্তুত নয়।
৫. অবকাঠামোর অভাব: দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে উচ্চ গতির ইন্টারনেট এবং প্রয়োজনীয় ডিজিটাল অবকাঠামোর অভাব রয়েছে। এটি ডিজিটাল কার্যক্রম পরিচালনায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে।
৬. আইনি ও নীতিগত জটিলতা: ডিজিটাল ডকুমেন্টের বৈধতা ও ই-সিগনেচারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আইনি ও নীতিগত জটিলতা দেখা দিতে পারে।
বাধা মোকাবিলার কৌশল
১. সরকারি প্রণোদনা: প্রাথমিক বিনিয়োগের অভাব পূরণে সরকার প্রণোদনা ও সহযোগিতা প্রদান করতে পারে। বিশেষত, ডিজিটাল সিস্টেম স্থাপনে কর রেয়াত এবং সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা প্রদান করা যেতে পারে।
২. প্রশিক্ষণ কর্মসূচি: প্রযুক্তিগত দক্ষতা উন্নয়নের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা আয়োজন করা হবে। এতে কর্মীদের প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে।
৩. সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা: সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উন্নত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যথাযথ সাইবার সিকিউরিটি পলিসি প্রণয়ন এবং নিয়মিত আপডেট ও মনিটরিং প্রয়োজন।
৪. পরিবর্তন ব্যবস্থাপনা: পরিবর্তন প্রতিরোধ মোকাবিলায় কর্মীদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে হবে। পরিবর্তনের গুরুত্ব ও সুবিধা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
৫. অবকাঠামো উন্নয়ন: দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে উচ্চ গতির ইন্টারনেট সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া, ডিজিটাল সিস্টেমের প্রয়োজনীয় হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার সরবরাহ করতে হবে।
৬. আইনি ও নীতিগত সমাধান: ডিজিটাল ডকুমেন্টের বৈধতা এবং ই-সিগনেচারের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন এবং নীতিমালা তৈরি করতে হবে।
পেপারলেস সমাজের উদাহরণ হিসাবে কিছু দেশ এবং প্রতিষ্ঠানকে উল্লেখ করা যেতে পারে, যারা ডিজিটাল পেমেন্ট এবং কাগজবিহীন সেবা গ্রহণ করেছে।
১. সুইডেন: সুইডেনকে বিশ্বের অন্যতম প্রথম পেপারলেস সমাজ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। দেশটির অধিকাংশ লেনদেন ডিজিটাল পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয়। নগদ অর্থের ব্যবহার অত্যন্ত কম এবং ব্যাঙ্ক ও দোকানগুলো ডিজিটাল পেমেন্টকে অগ্রাধিকার দেয়।
২. সিঙ্গাপুর: সিঙ্গাপুরে সরকারি সেবা, কর পরিশোধ, এবং অন্যান্য প্রশাসনিক কাজগুলো ডিজিটাল পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয়। নগদ অর্থের ব্যবহার কমিয়ে দেশটি ডিজিটাল লেনদেনের উপর জোর দিচ্ছে।
৩. ভারত: ভারতে “ডিজিটাল ইন্ডিয়া” উদ্যোগের মাধ্যমে পেপারলেস সোসাইটি গঠনের প্রচেষ্টা চলছে। ইউনিফাইড পেমেন্ট ইন্টারফেস (UPI) এবং অন্যান্য ডিজিটাল পেমেন্ট মাধ্যমের প্রচলন বাড়ছে। অনেক সরকারি সেবা এবং ব্যাংকিং কার্যক্রম অনলাইনে সম্পন্ন হচ্ছে।
৪. এস্তোনিয়া: এস্তোনিয়া ডিজিটাল সমাজের অন্যতম উদাহরণ। দেশটির নাগরিকরা তাদের অধিকাংশ সরকারি সেবা অনলাইনে পেয়ে থাকেন। ই-গভর্নেন্স এবং ই-রেসিডেন্সির মতো পরিষেবাগুলি অত্যন্ত জনপ্রিয়।
৫. চীন: চীনে আলিপে (Alipay) এবং উইচ্যাট পে (WeChat Pay) এর মতো ডিজিটাল পেমেন্ট মাধ্যমগুলো অত্যন্ত জনপ্রিয়। নগদ অর্থের ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে এবং অধিকাংশ লেনদেন ডিজিটাল পদ্ধতিতে সম্পন্ন হয়।
৬. স্টার্টআপ ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান: অনেক স্টার্টআপ এবং কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান পেপারলেস কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, গুগল, অ্যামাজন, এবং মাইক্রোসফটের মতো বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অধিকাংশ অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক কাজ ডিজিটাল পদ্ধতিতে সম্পন্ন করে।
পেপারলেস বাংলাদেশ গঠনে উপরের উল্লেখিত পদক্ষেপগুলি গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। প্রযুক্তিনির্ভর এই যুগে, ডিজিটাল পদ্ধতির মাধ্যমে আমরা কাগজের ব্যবহার কমিয়ে একটি আধুনিক, দক্ষ এবং পরিবেশবান্ধব সমাজ গড়ে তুলতে পারি। এজন্য সরকার, বেসরকারি খাত এবং সাধারণ জনগণকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। পেপারলেস সমাজ গঠন শুধু একটি আধুনিকায়নের প্রতীক নয়, বরং এটি একটি উন্নত ও টেকসই ভবিষ্যতের দিকেও আমাদের নিয়ে যাবে।
আলি আবরার, গণমাধ্যমকর্মী ও প্রকৌশলী