আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের প্রতি ভারতের সাম্প্রতিক কূটনৈতিক সম্পর্কের পরিবর্তন এবং পাকিস্তানের সঙ্গে তালেবান সরকারের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা অঞ্চলটির ভূ-রাজনৈতিক অবস্থার গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
আফগানিস্তান তালেবান সরকারের হাতে আসার প্রায় তিন বছরের পর, সম্প্রতি ভারতের কূটনীতিক পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি দুবাইয়ে তালেবানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ২০২১ সালে তালেবান সরকার ক্ষমতায় আসার পর উভয় পক্ষের মধ্যে এটিই প্রথম উচ্চ-পর্যায়ের বৈঠক।
বৈঠকে বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং ইরানের চাবাহার বন্দরের উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। চাবাহার বন্দরকে পাকিস্তানের করাচি ও গদার বন্দরের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করতে চায় ভারত। তালেবান সব সময়ই ভারতকে “একটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক এবং অর্থনৈতিক শক্তি” হিসেবে অভিহিত করে এবং তারা ভারতের সাথে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর আফগানিস্তান বিষয়ে ২০২৩ সালে সংসদে বলেন, ভারতের সঙ্গে আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক ও সভ্যতাগত সম্পর্ক রয়েছে। আফগানিস্তানে ভারত ৫০০টিরও বেশি প্রকল্পে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে রাস্তা, বিদ্যুৎ লাইন, বাঁধ, হাসপাতাল ও ক্লিনিক। এছাড়া আফগান কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তির মতো নানা কর্মসূচি চালু করেছে।
ভারতের সঙ্গে তালেবানের সম্পর্ক জোরদারের আরেকটি কারণ হিসেবে ধরা হয় পাকিস্তানের সঙ্গে তালেবান সরকারের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা। এদিকে পাকিস্তান দাবি করে কট্টরপন্থী পাকিস্তানি তালেবান (টিটিপি) আফগানিস্তানে আশ্রয় গ্রহণ করে সেখান থেকে কাজ করছে।
গত জুলাইয়ে,পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী খাজা আসিফ বিবিসিকে বলেছিলেন, সন্ত্রাসবাদ দমনের লক্ষ্যে অভিযানের অংশ হিসেবে পাকিস্তান আফগানিস্তানে হামলা চালিয়ে যাবে। আফগান সরকারের মতে, ভারত ও তালেবানের মধ্যে আলোচনার কয়েকদিন আগে পূর্ব আফগানিস্তানে পাকিস্তানি বিমান হামলায় ১২ জনের উপরে নিহত হয়েছেন। এরপর তালেবান সরকার তাদের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন বলে হামলার নিন্দা করেছে।
স্পষ্টতই, সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের নেওয়া উদ্যোগ তালেবান নেতৃত্বাধীন আফগানিস্তানে তার মূল স্বার্থকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে। ভারতের জন্য সন্ত্রাসবাদের হুমকি রোধ করা, ইরান ও মধ্য এশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ গভীর করা, সাহায্যের মাধ্যমে জনগণের সদিচ্ছা বজায় রাখা এবং একটি সংগ্রামী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করা।
এদিকে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত জয়ন্ত প্রসাদও বলেছেন, “আমরা চাই না তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হোক। এটি আমাদের দেশের স্বার্থ রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।”
এ বিষয়ে উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, “তালেবানের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা পাকিস্তানের জন্য বড় একটি আঘাত।”
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, তালেবান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে ভারত আফগানিস্তানের জনগণের সমর্থন ধরে রাখতে সক্ষম হবে। পাশাপাশি, এটি সন্ত্রাসবাদের হুমকি প্রতিরোধ করবে এবং মধ্য এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে।
যদিও এই সম্পর্কের উন্নতিতে ঝুঁকিও কম নয়। কুগেলম্যান বলেন, “তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার মূল ঝুঁকি তালেবান নিজেই। আমরা এমন একটি সহিংস এবং নির্মম সত্তার কথা বলছি, যার আন্তর্জাতিক বিশেষ করে পাকিস্তানি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এবং এটির ১৯৯০-এর তুলনায় খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি,”
তিনি আরও বলেন, “ভারত আশা করতে পারে যে, তালেবানকে ‘পাশে’ রাখতে পারলে, তালেবান ভারতের বা তার স্বার্থের ক্ষতি করার সম্ভাবনা কম। এবং তা সত্য হতে পারে। শেষ পর্যন্ত, আপনি কি তালেবানের মতো একটি সত্তার ওপর সত্যিই ভরসা করতে পারেন? এটি এমন একটি অস্বস্তিকর প্রশ্ন যা ভারতকে এই জটিল সম্পর্ক অনুসরণ করার সময় ভাবতে হবে।”
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, তালেবানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের আকাঙ্ক্ষা তাদের দেশের অভ্যন্তরীণ সংস্কার আনতে বাধ্য করতে পারে। যেমন নারীদের শিক্ষার সুযোগ, কর্মসংস্থান ও রাজনৈতিক অধিকার পুনর্বহালের মাধ্যমে তালেবান এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে।
নারীদের প্রতি তালেবানের আচরণ নিয়ে উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও গবেষক মি. প্রসাদ আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের বর্তমান সম্পর্কের কোনো খারাপ দিক দেখেন না।
তিনি বলেন, “তালেবান পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আছে। তালেবানকে তার নিজের অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া আফগান জনগণের জন্য কোনো উন্নতি আনবে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কিছু সম্পৃক্ততা হয়তো সরকারের আচরণ উন্নত করতে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।”
তিনি আরও জানান, “মনে রাখবেন, তালেবান স্বীকৃতির জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা করছে, তারা জানে যে অভ্যন্তরীণ সংস্কারের পরই তা সম্ভব। যেমন নারীকে আবার জনজীবনে ফিরিয়ে আনা এবং তাদের শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণের অধিকার পুনর্বহাল করা।”
এভাবেই আফগানিস্তানে ভারতের কৌশলগত পদক্ষেপ তার দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থ রক্ষা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় অবদান রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সূত্র- বিবিসি