উত্তরাঞ্চলের লাখো মানুষের চিকিৎসাসেবার অন্যতম ভরসাস্থল রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতাল। তবে প্রতিষ্ঠানটিকে অনিয়ম-দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছে এখানকার প্রশাসন। হাসপাতালে সাংবাদিক প্রবেশে মৌখিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে কোটি টাকার নিয়োগ, চাঁদাবাজি ও টেন্ডার বাণিজ্যে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে একটি চক্র। এ নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরে লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র ও লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের আমলে তারা সেই সরকারের কাছের লোক হিসেবে পরিচিত ছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায় হলেও তাদের দাপট কমেনি। এখনো নানা অপকর্মে জড়িত হাসপাতাল প্রশাসন। ইন্টার্ন নার্সদের থেকে চাঁদাবাজি, নিয়োগ ও টেন্ডার বাণিজ্যে তাদের নাম আসছে।
লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. আবু তালেব খাবারের টেন্ডার দেওয়ার নাম করে এবিসি ইন্টারন্যালনাল লিমিটেডের কাছ থেকে ৬০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন। কিন্তু টেন্ডার দিয়েছেন জনপ্রিয় গ্রুপকে। এখন ঘুষের টাকা ফেরত চাইলে নানা রকম হুমকি দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
এছাড়া আরেক ভুক্তভোগী অফিস কাম-কম্পিউটার অপারেটর পদে নিয়োগ দিতে ৩০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন। আর একাজে তার অন্যতম সহযোগী হাসপাতালের নার্স জান্নাতুল ফেরদাউস। সম্প্রতি সরকারি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে শপিং করতে গিয়ে নেটিজনের সমালোচনায়ও পড়েন আবু তালেব।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য ও অনুসন্ধানে দেখা যায়, হাসপাতাল পরিচালককে ম্যানেজ করে দীর্ঘ সময় ধরে টেন্ডার ও নিয়োগ বাণিজ্যসহ ইন্টার্ন নার্সদের থেকে চাঁদাবাজিও করে যাচ্ছেন ডা. আবু তালেব। প্রভাব খাটিয়ে নিজের অন্তত আটজন আত্মীয়-স্বজনকে হাসপাতালে চাকরি দিয়েছেন। অর্থের বিনিময়ে নিজ এলাকার মানুষকেও চাকরি দিয়েছেন হাসপাতালে। যারা রোগীর পকেট কাটতে নানা অপকর্মে লিপ্ত হচ্ছে। এতে অতিষ্ঠ সাধারণ রোগীরা। রোগীদের নানা অভিযোগ পরিচালকের কাছে গেলেও তিনি সেগুলো আমলে তো নিচ্ছেনই না, উল্টো এসব তথ্য কীভাবে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে যাচ্ছে, তা নিয়ন্ত্রণে কঠোরতা আরোপ করেছেন পরিচালক।
জানা যায়, সর্বশেষ রামেকে চার ক্যাটাগরির পদে ছয় কর্মী নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। যেখানে একজন ড্রাইভার, দুজন অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক, একজন টেলিফোন অপারেটর, দুজন ইলেকট্রিশিয়ানকে নিয়োগ দেওয়া হবে। এরইমধ্যে সকল পরীক্ষা শেষ হয়েছে। এখন শুধু ফলাফল বাকি। এরমধ্যে একজন নিয়োগ প্রত্যাশী ৩০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছেন অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে নিয়োগের জন্য।
অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতাল প্রশাসন অন্য পদগুলোর জন্যও মোটা অঙ্কের বাণিজ্য করছেন। শিগগির হয়ত সেগুলোও বেরিয়ে আসবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই নিয়োগ বাণিজ্যের মূল হোতা হাসপাতাল পরিচালক নিজেই। সহকারী পরিচালক ডা. আবু তালেব তার অন্যতম সহযোগী। আবু তালেবের সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন সিনিয়র স্টাফ নার্স জান্নাতুল ফেরদাউস। শুধু এই পদে নয়; হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতা কর্মী থেকে শুরু করে সব পদের নিয়োগেই বাণিজ্য চলছে। এই ঘুষের টাকায় কর্তাদের বিলাসী জীবনযাপন ও রাজশাহী নগরীতে ফ্ল্যাট-প্লটের আলোচনা হাসপাতালের ‘টপ সিক্রেট’।
তথ্য অনুসন্ধানে দেখা যায়, আউট সোর্সিং কর্মী হিসেবে আবু তালেব তার অন্তত আটজন স্বজনকে নিয়োগ দিয়েছেন। তারা হলেন-ভাতিজা মো. সাদিকুল ইসলাম তুহিন, ভাতিজি ল্যাব অ্যাসিটেন্ট মোসা. জুরিয়া খাতুন, ভাতিজি জামাই রওনক হোসেন, বেয়াইন মোসা. রেনুফা বেগম, নাতনি ল্যাব টেকনোলজিস্ট রোকসানা খাতুন, আত্মীয় আজিম আলী। এছাড়া এলাকার রুনা লাইলা নামের এক নারীকে হাসপাতালে আউট সোর্সিংয়ে নিয়োগ দিয়ে নিজের বাসার কাজ করাচ্ছেন ডা. আবু তালেব।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের সাবেক এক কর্মী বলেন, হাসপাতালে টাকা ছাড়া একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মীও নিয়োগ হয় না। এটা ওপেন সিক্রেট। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের টিকিট কাউন্টারে ডা. আবু তালেবের আত্মীয়-স্বজনদের রাখা হয়েছে। যারা টিকিটের অতিরিক্ত মূল্য আদায় করে। সে ভাগ পরিচালক পর্যন্তই পৌঁছায়।
এ বিষয়ে জানতে হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. আবু তালেবের মুঠোফোনে কয়েক দিন ধরে কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। রোববার ফোন রিসিভ করে সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর তিনি বলেন, ‘সাংবাদিক, আচ্ছা। ব্যস্ত আছি। পরে কথা বলবো।’ এরপর ফোন কেটে দেন তিনি।
এদিকে রামেক হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনালের শামীম আহম্মদের মুঠোফোনে একাধিক দিন কল করা হলে ব্যস্ততার অজুহাতে এ নিয়ে কথা বলতে চাননি।
এ বিষয়ে রাজশাহী বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক ডা. মো. হাবিবুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘অভিযোগের কপি আমাদের কাছেও এসেছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।’
এ বিষয়ে জানতে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. আবু জাফর ও অতিরিক্ত পরিচালক মো. রেজওয়ানুর রহমানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য পাওয়া যায়নি।