সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে সংকট তৈরি হবে— কিছুদিন আগে এমন মন্তব্য করেছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। আজ এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করেন দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক সাইফুল আলম। তিনি বলেন, আপনার সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন সিন্ডিকেটে হাত দেওয়া যাবে না।
তখন প্রধানমন্ত্রী বলেন, সিন্ডিকেটে হাত দেওয়া যাবে না কে বলেছে? আমি জানি না। যখনই দ্রব্যমূল্য বাড়ে তখনই আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।
এরপর সাইফুল আলম জানান, এটি বলেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী। তখন শেখ হাসিনা বলেন, আমি বাণিজ্যমন্ত্রীকে ধরব।
গত ২৬ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় খাতে ছাঁটাই প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় বিরোধী দলের সদস্যদের অভিযোগ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছিলেন- এ কথা ঠিক যে বড় বড় গ্রুপগুলোই একসঙ্গে অনেক বেশি ব্যবসা করে। কিন্তু, একটা জিনিস মনে রাখা দরকার, জেলে ভরলাম, জরিমানা করলাম, সেটা হয়তো করা সম্ভব। কিন্তু, তাতে যে সংকটটা হঠাৎ করে তৈরি হয়, আমাদের তো সেটা সইতে কষ্ট হয়। আমরা চেষ্টা করি আলোচনার মাধ্যমে, নিয়মের মধ্যে থেকে কিছু করতে।
আজকের সংবাদ সম্মেলনে সরকারপ্রধান বলেন, আমাদের খাদ্যপণ্য নিয়ে কয়েকটা হাউজ ব্যবসা করে। তারা যখন কৃত্রিমভাবে দাম বাড়ায় আমরা তখন আমদানি করি। বিকল্প ব্যবস্থা করি, যাতে তারা বাধ্য হয়ে দাম কমায়। সাথে সাথে আমরা ব্যবস্থা নিই। সিন্ডিকেট থাকলে সিন্ডিকেট ভাঙা যাবে না— এটা কোনো কথা না। কে কত বড় শক্তিশালী সিন্ডিকেট আমি জানি না। এটা আমি দেখব। ব্যবস্থা নেব।
তিনি আরও বলেন, আমি ছোটকালে দেখেছি, প্রথম শিম উঠলে কে কত টাকা দিয়ে কিনতে পারে প্রতিযোগিতা হতো। দুইদিন পরে তার দাম কমে যেত। বর্ষাকালের কাঁচা মরিচের দাম বাড়ে। এখন বিকল্প ব্যবস্থা রয়েছে। শুকনো করে রেখে দেওয়া যায়। পেঁয়াজ শুকিয়ে রাখা যায়। প্রতিটা জিনিসের বিকল্প ব্যবস্থা রয়েছে। বর্ষাকালে শিম, গাজর, কাঁচা মরিচ পাওয়া যেত? এখন পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের কৃষিবিদরা গবেষণা করে এখন ১২ মাস উৎপাদন করতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমাদের তরকারি এখন সুইজারল্যান্ডেও যাচ্ছে। আমাদের কিছু জিনিস বাইরে যাচ্ছে। আমরা যত উৎপাদন করতে পারব, আমাদের নির্ভরশীরতা যদি কমে, সিন্ডিকেট এমনিই ভেঙে যাবে। ওদের আর কিছু করা লাগবে না। সেজন্য বলছি এক টুকরো জমি যেন পতিত না থাকে।
তিনি বলেন,দেশের বাজারে ডিমের দাম যখন কমবে, যখন বেশি ডিম পাবেন, তখন সিদ্ধ করে ফ্রিজে রেখে দেবেন। তাহলে বহুদিন ভালো থাকবে। ভর্তাও খাওয়া যায়। আমরা রাখি বলে বলছি।
পেনশনের টাকায় নির্বাচনী ফান্ড করতে হবে—আ.লীগ এত দীনতায় পড়েনি: সংবাদ সম্মেলনে সর্বজনীন পেনশন নিয়ে চলা অপপ্রচার প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, সর্বজনীন পেনশন স্কিমের টাকা নিয়ে ইলেকশন ফান্ড গঠন করতে হবে আওয়ামী লীগ এত দীনতায় পড়েনি। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ হলো নিজের খেয়ে নৌকা… সাধারণ মানুষ নিজের খেয়ে নৌকায় ভোট দেয়, এটাই হলো বাস্তবতা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারি কর্মচারীরা পেনশন পায় কিন্তু বেসরকারি চাকরিজীবী বা সাধারণ মানুষ পেনশন পায় না। তাদের কথা চিন্তা করেই এটা করা হয়েছে। পেনশন স্কিমে স্পষ্ট বলা হয়েছে, এই স্কিমে এখন যে টাকা রাখবে পরবর্তীতে নির্দিষ্ট বয়সসীমার পর সে টাকা পাবেন। অথবা মাঝখানে কেউ তুলে নিতে চাইলে সেটাও নিতে পারবে। এটা নিয়ে নেতিবাচক কথা বলার সুযোগ নেই। যারা এখন নেতিবাচক কথা বলছে তারা এক সময় এই পেনশন স্কিমে আসবে, এটা বলে রাখলাম।
জনগণকে আশ্বাস দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই টাকা অন্য কোথাও নেওয়ার সুযোগ নেই। নয়-ছয় করা যাবে না।
নেতিবাচক প্রচারণা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ দেশ তো ছয় ঋতুর দেশ। সবাই সবকিছু সহজে ভুলে যায়। পেনশন স্কিমটি আমাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল, এখন সেটি বাস্তবায়ন করছি। এটা আওয়ামী লীগ সরকারের জনকল্যাণমুখী কাজ। এটা নিয়েও সমালোচনা, নেতিবাচক প্রচারণা করছে। যারা পরশ্রীকাতর, সবসময় অন্যের দোষ খোঁজে, হতাশায় ভোগে, তারাই ভালো কাজের নেতিবাচক প্রচারণা চালায়।
পাঁচ দেশের জোট ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিতে গত সপ্তাহে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যান শেখ হাসিনা। জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে যোগ দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুই ইনাসিও লুলা দা সিলভা। সম্মেলন শেষে ২৭ আগস্ট দেশে ফেরেন প্রধানমন্ত্রী।
দক্ষিণ আফ্রিকায় এই সফরের ইতিবাচক দিক তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্যাংশন ও কাউন্টার স্যাংশনের এ যুগে এ সফরের মাধ্যমে ব্যবসা বাণিজ্যের সম্প্রসারণসহ বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে গেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, বৈশ্বিক দক্ষিণে অবস্থানকারী দেশসমূহের উপর আরোপিত কৃত্রিম সিদ্ধান্ত এবং বিভাজনের নীতিকে না বলার এখন উপযুক্ত সময়। সর্বজনীন নিয়ম ও মূল্যবোধকে অস্ত্রে পরিণত করার প্রচেষ্টাকে আমাদের অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করতে হবে। আমাদের নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা- নিষেধাজ্ঞার চক্র বন্ধ করতে হবে।
তিনি বলেন, সভায় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে আমার সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের চিত্র বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছি। একই সঙ্গে আমরা রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের বিভিন্ন প্রস্তুতি ও কার্যক্রম সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সস্প্রদায়কে অবহিত করেছি।
তিনি আরও বলেন, দক্ষিণের দেশগুলোর ওপর আরোপিত কৃত্রিম সিদ্ধান্তের কারণে আমরা আর ক্ষতিগ্রস্ত হতে রাজি নই। সর্বজনীন নিয়মের নামে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া অসমনীতিকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য আমি দক্ষিণের দেশগুলোকে আহ্বান জানিয়েছি।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের প্রসঙ্গও উঠে আসে। নির্বাচন ও ভোট প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, যে নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারে সেটাই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। বিগত কয়েকটি নির্বাচনে জনগণ ভালো পরিবেশে ভোট দিয়েছে, আগামীতে ভালোভাবে ভোট দিতে পারবে। জনগণ যাকে ভোট দেবে তারাই ক্ষমতায় আসবে, এটাই বিশ্বাস করি।
বিএনপির দিকে ইঙ্গিত করে সরকারপ্রধান বলেন, এই দলটি ক্ষমতায় গেলে দুর্নীতি করে কিছু টাকা যাবে গুলশানে, কিছু যাবে হাওয়া ভবনে, বাকিটা যাবে লন্ডনে। নিজেরা নিজেরা মারামারি করবে, দুর্নীতি করতে করতে এক সময় তারা বলবে আমরা পারবো না। সেই দলকে জনগণ ভোট দেবে?
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এতো উন্নয়নের পর জনগণকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কী চায়। মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি, খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি, কোনো খাদ্য ঘাটতি নেই। যা কিছু করেছি, সব তো জনগণের কাজে লাগছে। সবই তো জনগণ ভোগ করছে। মেট্রোরেল করতে গিয়ে আমাদের নানা কথা শুনতে হয়েছে। সব জায়গায় কথা শুনতে হচ্ছে। আর উন্নয়ন করে সবার প্রশংসা পাব, এটা আশা করিও না। আশা করাও ঠিক হবে না। যাদের এক সময় জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছিল তারা তো এখন সমালোচনা করবেই।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, জনগণের জন্য কাজ করছি, জনগণের জন্য আছি, ১৪ বছরের মধ্যে দেশকে কোথায় নিয়ে এসেছি, সেটাও দেখতে হবে। টানা ক্ষমতায় থাকার কারণে দেশের দ্রুত একটি পরিবর্তন আনা সহজ হয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বলেই এটা সম্ভব হয়েছে।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সুদূরপ্রসারী প্ল্যান করে রাখে। যখনই ক্ষমতায় আসি সেগুলো নিয়ে কাজ করি। ডিজিটাল রূপকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। দেশে গরীব মানুষ একটাও থাকবে না।
দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের বিষয়ে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন হলেও এখানে অন্যান্য আরও অনেক বিষয় নিয়েই কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। এক পর্যায়ে উঠে আসে শান্তিতে নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিচার প্রসঙ্গও। এ সময় তাকে ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেন, ভদ্রলোকের যদি এতোই আত্মবিশ্বাস থাকে যে তিনি অপরাধ করেননি, তাহলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিবৃতি ভিক্ষা করে বেড়াতেন না।
তিনি বলেন, যারা বিবৃতি দিয়ে তার বিচার স্থগিত করতে বলেছেন তাদের বলছি, বিবৃতি না দিয়ে আইনজীবী পাঠাক। এক্সপার্টরা দেখুক, অনেক কিছু পাবেন। আমাদের দেশের বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন। সবকিছুই আইন মতো চলে। কেউ যদি ট্যাক্স (কর) না দেয় আর যদি শ্রমিকের অর্থ আত্মসাৎ করে, শ্রমিকদের পক্ষ থেকে যদি মামলা করা হয়… আমাদের কি সেখানে হাত আছে যে মামলা বন্ধ করে দেবো?
ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দেওয়ার বিষয়ে অবহিত করতে আজ মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধানমন্ত্রী। গত ২২ আগস্ট সম্মেলনে যোগ দিতে দক্ষিণ আফ্রিকা যান তিনি। ফিরে আসেন ২৭ আগস্ট।
পিএসএন/এমঅাই