রানি ভিক্টোরিয়ার একটি সুগন্ধী নিয়ে এখনও যেন আগ্রহের শেষ নেই। গভীর সমুদ্রে জাহাজের ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ধার হওয়া প্রায় ১৫০ বছরের পুরোনো ওই সুগন্ধীর পুনর্জন্ম হয় ২০১৪ সালে। আজও রমরমিয়ে বিক্রি হচ্ছে সেই সুগন্ধী এবং এখনও এটি বেশ জনপ্রিয়। ওই সুগন্ধীর সন্ধান পাওয়া এবং তারপর তা থেকে নতুন করে ফের সেই একই সুগন্ধী প্রস্তুত করার কাজটি মোটেও সহজ ছিল না। সুগন্ধী বিশেষজ্ঞ ইসাবেল রামসে ব্রাকস্টোনের সেই সব দিনের গল্পই আজ জানাব।
২০১১ সালে একটি বড় ঝড়ের প্রকোপে পড়েছিল বারমুডা দ্বীপ। ঝড় থেমে যাওয়ার পর ওই দ্বীপের তদারকির দায়িত্বে থাকা বাহিনী দ্বীপের চারপাশ ঘুরে দেখার সময়ই ডুবুরির একটি দল সমুদ্রের নিচে একটি জাহাজের ভাঙা অংশের খোঁজ পায়।
ম্যারি সেলেস্টিয়া, জাহাজের ধ্বংসস্তূপের গায়ে এই নামটাই লেখা ছিল। জানা যায়, ১৮৬৪ সালে উত্তর ক্যারোলিনা যাওয়ার সময় ডুবে গিয়েছিল জাহাজটি। এই জাহাজের ভেতর থেকে বেশ কিছু পুরোনো জিনিস উদ্ধার করা হয়। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে খোঁজ চালানোর পর জাহাজের ভেতর থেকে জুতা, মদের বোতল, এবং দু’টি সুগন্ধীর ছোট বোতল পাওয়া যায়। জিনিসগুলো একসঙ্গে একটি বাক্সের মধ্যে রাখা ছিল।
সুগন্ধীর দু’টি বোতলের গায়ে ‘পিসে অ্যান্ড লুবিন লন্ডন’ লেখা ছিল। সুগন্ধী বিশেষজ্ঞ এবং প্রস্তুতকারক ইসাবেল রামসে ব্রাকস্টোন বোতল দু’টি দেখে চমকে ওঠেন। সেগুলো যে কতটা মূলবান তা তিনি এক ঝলকেই বুঝে গিয়েছিলেন।
রামসের একটি সুগন্ধী বিক্রির দোকান রয়েছে। তিনি জানান, ১৮০০ সালের দিকে সুগন্ধী তৈরির কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল লন্ডন। সে সময় ধনীরাই মূলত ঘনিষ্ঠজনদের সুগন্ধী উপহার হিসেবে দিতেন। লন্ডনের বন্ড স্ট্রিটের ‘পিসে অ্যান্ড লুবিন’ ছিল খুবই জনপ্রিয় একটি সুগন্ধী সংস্থা। যে দু’টি বোতল উদ্ধার হয়েছিল তার একটির ভেতরে সমুদ্রের পানি ঢুকতে পারেনি। কিন্তু অন্য বোতলে পানি ঢুকে সুগন্ধী নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
বোতলটি খুলে ঘ্রাণ নেওয়ার পরই রামসে স্থির করে ফেলেছিলেন নতুন করে সেই সুগন্ধীই তিনি আবারও তৈরি করবেন। কিন্তু সে সময়ের সঙ্গে আজকের সুগন্ধীর অনেক পার্থক্য তৈরি হয়েছিল। সুগন্ধী তৈরিতে ব্যবহৃত উপাদানেও অনেক অমিল ছিল। আগে সুগন্ধীর সব উপাদানই ছিল প্রাকৃতিক। কিন্তু এখন গবেষণাগারে কৃত্রিম উপাদান দিয়েই তৈরি হয় সুগন্ধী।
২০১১ সালে খোঁজ মিলেছিল ওই জাহাজটির। তার তিন বছর পর ২০১৪ সালে হুবহু একই সুগন্ধী বানাতে সফল হন রামসে। এই তিন বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে তাকে। যদিও আইন অনুযায়ী, উদ্ধার হওয়া এই সুগন্ধী রামসের হাতে দেওয়া বেআইনি। কিন্তু কিছুটা সুগন্ধী নিজের সংগ্রহে রাখার অনুমতি আদায় করে নিয়েছিলেন তিনি।
সুগন্ধী নিয়ে নিউ জার্সির এক বিখ্যাত সুগন্ধী প্রস্তুতকারক সংস্থায় কর্মরত বন্ধু জেন ক্লডের কাছে যান তিনি। সুগন্ধী প্রস্তুত করার প্রথম ধাপ, তাতে উপস্থিত উপাদানগুলো সম্পর্কে সচেতন হওয়া। দ্বিতীয় ধাপে উপাদানগুলোর নির্দিষ্ট পরিমাণ জানতে হবে। বন্ধু জেন যে সংস্থায় কাজ করতেন সেটি ছিল আমেরিকার বিখ্যাত সুগন্ধী প্রস্তুতকারক সংস্থা। ওই পুরোনো সুগন্ধীর মধ্যে কী কী উপাদান কতো পরিমাণে রয়েছে তা জানতে বিভিন্ন প্রযুক্তির সাহায্য নেন তারা।
ঘ্রাণ নিয়ে তারা বুঝতে পেরেছিলেন, তাতে কমলালেবু, আঙুর, কিছু মশলা, ফুল, চন্দনকাঠ এ সব একাধিক উদ্ভিজ্জ উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে। এর বাইরে প্রাণীজ অনেক উপাদানও মেশানো হয়েছিল। যেমন গন্ধগোকুলের ফেরোমন এবং স্পার্ম, তিমির পরিপাক নালী থেকে নির্গত একপ্রকারের উপাদান আম্বারগিস। এই আম্বারগিস উপকূল থেকে সংগ্রহ করে প্রসাধন হিসাবে ব্যবহার করতেন সাধারণ মানুষ।
বিভিন্ন পরিমাণে এগুলো মিশিয়ে, একাধিক বার চেষ্টার পর হুবহু সেই সুগন্ধী তৈরি করতে সক্ষম হন তারা। ডুবে যাওয়া জাহাজের নামে এর নামকরণ করা হয় ‘ম্যারি সেলেস্টিয়া’।
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে খুব কম পরিমাণে এই সুগন্ধী বাজারে আনেন রামসে ব্রাকস্টোন। মাত্র ১ হাজার ৮৬৪টি বোতল তৈরি করেছিলেন তিনি। যেহেতু ১৮৬৪ সালে জাহাজটি ডুবে গিয়েছিল সে কারণেই প্রথমে ওই সংখ্যক সুগন্ধীর বোতল প্রস্তুত করা হয়েছিল।
অল্প সময়ের মধ্যেই সব সুগন্ধী বিক্রি হয়ে যায়। বহু ক্রেতা এই সুগন্ধীর জন্য হন্যে হয়ে খোঁজ শুরু করেন। ক্রেতাদের চাহিদা দেখে ফের এই সুগন্ধী বানাতে শুরু করেন রামসে। তার হাতেই নবজন্ম হয়েছিল ১৪৭ বছরের পুরোনো ওই সুগন্ধীর। আজও রামসের দোকান লিলি বারমুডায় পাওয়া যাচ্ছে ওই সুগন্ধী। এর প্রতিটির দাম ১৩০ ডলার বা বাংলাদেশের বাজারমূল্যে প্রায় ১১ হাজার টাকা।