মহামারি আকারে না হলেও বিশ্বময় করোনা এখনো শেষ হয়নি। এরমধ্যেই ছড়িয়ে পড়ছে আরেক ভাইরাস মাঙ্কিপক্স। আক্রান্ত কিছু কিছু রোগীর জন্য এ ভাইরাস প্রাণঘাতী হতে পারে বলেও মনে করছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রোস আডানম গেব্রিয়াসিস। তিনি মাঙ্কিপক্সকে ‘শনাক্তযোগ্য ও বর্ধনশীল ব্যাধি’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
রোববার (২২ মে) পর্যন্ত ইউরোপ, উত্তর আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্য অঞ্চলের ১২টি দেশে মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইট গ্লোবাল হেলথের তথ্য বলছে, বিশ্বে এখন পর্যন্ত ১১১ জন মাঙ্কিপক্স ভাইরাসে সংক্রমিত অথবা সন্দেহভাজন আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন। এই ১২টি দেশ হচ্ছে- অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, পর্তুগাল, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, ইতালি, যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
বিশ্বজুড়ে এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আক্রান্ত দেশে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। মাঙ্কিপক্স শনাক্ত এবং আক্রান্তদের চিকিৎসায় সহায়তা করছে এই স্বাস্থ্য সংস্থা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাঙ্কিপক্স একটি বিরল ও অপরিচিত রোগ। ‘মাঙ্কিপক্স ভাইরাস’ এ রোগের জন্য দায়ী। তাদের মতে, পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার উষ্ণ ও আর্দ্র বনাঞ্চলের বানররা ছিল এ রোগের প্রথম শিকার। তারপর একসময় ধীরে ধীরে মানবদেহেও সংক্রমণ ঘটায় মাঙ্কিপক্স। এটি দেখতে গুটিবসন্তের প্রজাতির মতো। এই প্রজাতির মধ্যে রয়েছে ভেরিওলা ভাইরাস; যা গুটিবসন্তের কারণ, ভ্যাক্সিনিয়া ভাইরাস ও কাউপক্স ভাইরাস।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে পরীক্ষা করে মাঙ্কিপক্সের দু’টি প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে। এর একটি ‘কঙ্গো প্রজাতি’ এবং অপরটি ‘মধ্য আফ্রিকান প্রজাতি’।
তবে নতুন এই ভাইরাস মাঙ্কিপক্স কতটা প্রাণঘাতী, তাই নিয়ে বিস্তর কাজ করছেন দেশ-বিদেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ‘কঙ্গো প্রজাতি’র প্রাদুর্ভাব অত্যন্ত গুরুতর। ওই অঞ্চলে কঙ্গো প্রজাতিতে আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর হার ১০ শতাংশেরও বেশি। ভয়াবহ হচ্ছে, এতে বাচ্চাদের মৃত্যুর সম্ভাবনা বেশি। অন্যদিকে, ‘মধ্য আফ্রিকান প্রজাতি’র তীব্রতা তুলনামূলক কম। এই প্রজাতিতে আক্রান্তদের মৃত্যুর হার ১ শতাংশের মতো।
তবে, ১২টি দেশে শনাক্ত হওয়া মাঙ্কিপক্স আসলে কোন প্রজাতির তা এখনো সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। যদিও যুক্তরাজ্যে আক্রান্তদের মধ্যে ‘মধ্য আফ্রিকান প্রজাতি’ শনাক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ।
নতুন এই ভাইরাস মাঙ্কিপক্স নিয়ে মহামারি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর সংক্রমণ সাধারণত একেবারে বিরল। যুক্তরাষ্ট্রের রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (সিডিসি) মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ বৃদ্ধির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সকলকে সতর্ক করে তারা বলেছেন, পর্তুগাল ও স্পেনের প্রাদুর্ভাবের পাশাপাশি যুক্তরাজ্যেও এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়তে পারে।
ভাইরাসটি মানবদেহে বেশ কয়েকটি উপায়ে প্রবেশ করতে পারে বলে জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামারি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এরিক ফেইগল ডিং। তার মতে, ইঁদুর ও কাঠবিড়ালির মতো প্রাণীর মাধ্যমেও ভাইরাসটি মানবদেহে ছড়িয়ে পড়তে পারে। মানুষ থেকে মানুষেও সংক্রমণ ছড়াতে পারে।
এ ছাড়াও যেসব কারণে একজন মানুষ মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হতে পারেন বলে মনে করেন এই বিশিষ্ট চিকিৎসক, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-
• ভগ্ন ত্বক
• শ্বাসতন্ত্র অথবা চোখ, নাক ও মুখ
• সংক্রমিত প্রাণীর কামড়
• আক্রান্ত প্রাণী অথবা মানুষের রক্ত বা পশম স্পর্শ
• সংক্রমিত প্রাণীর মাংস সঠিকভাবে রান্না ছাড়া খাওয়া
• ফুসকুড়ি রয়েছে এমন কারো ব্যবহৃত পোশাক, বিছানা স্পর্শ
• মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত কারও ত্বকের ফোস্কা অথবা খোসপাঁচড়া স্পর্শ অথবা সংক্রমিত ব্যক্তির কাশি ও হাঁচির খুব কাছাকাছি যাওয়া
এই ভাইরাস চিহ্নিত হওয়ার পর এর ওষুধ বা ভ্যাকসিন নিয়ে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। তবে এখন পর্যন্ত মাঙ্কিপক্সের নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ বা ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়নি। প্রাথমিকভাবে এর সংক্রমণ রোধে গুটিবসন্তের টিকা ব্যবহার করা হচ্ছে। ডব্লিউএইচও জানিয়েছে, স্মলপক্স বা গুটিবসন্তের জন্য ব্যবহৃত টিকা মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধে ৮৫ শতাংশ কার্যকর। রোগীদের সেবা দেওয়ার সময় এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার বেশি ঝুঁকিতে যারা আছেন, সেসব স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের ইতোমধ্যে গুটিবসন্তের টিকা দেওয়া শুরু করেছে যুক্তরাজ্য।
অপরদিকে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার বলেছে- পুরো দেশের মানুষকে আপাতত গুটিবসন্তের টিকা দেওয়ার জন্য তাদের কাছে যথেষ্ট ভ্যাকসিন মজুত আছে। দেশটির স্বাস্থ্য ও মানবসেবা বিভাগের একজন বিশেষজ্ঞ এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, গুটিবসন্তের জন্য অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ আছে। যা বর্তমান পরিস্থিতিতে মাঙ্কিপক্সের চিকিৎসায় ব্যবহার করা যেতে পারে।
এদিকে, সারাবিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়া মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে আমাদের প্রতিটি বন্দরে সতর্ক অবস্থা জারি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
এই বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, এয়ারপোর্ট, ল্যান্ড পোর্টসহ সব পোস্টগুলোকে আমরা সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। এসব বন্দর দিয়ে সন্দেহভাজন কেউ প্রবেশ করলে তাকে চিহ্নিত করার পাশাপাশি অতিদ্রুত তাকে সংক্রমণ ব্যাধি হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়ার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, মাঙ্কিপক্স রোগটির বিভিন্ন লক্ষণের মধ্যে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, ঘেমে যাওয়া, পিঠে ব্যথা, মাংসপেশির টান ও অবসাদ। প্রথম পর্যায়ে রোগীর জ্বর আসে, পাশাপাশি শরীরে দেখা দেয় ফোস্কা ও অধিকাংশ ঘটনায় শুরুতে মুখে ফুসকুড়ি ওঠে। পরে শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে; বিশেষ করে হাত ও পায়ের তালুতে।