‘দেশটাকে তো জাহান্নাম বানিয়ে ফেলেছেন’- হাইকোর্টের বিচারপতির এমন মন্তব্য অসাংবিধানিক ও অসৌজন্যমূলক বলে উল্লেখ করেছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ এএম আমিন উদ্দিন।
মঙ্গলবার (১০ অক্টোবর) অ্যাটর্নি জেনারেলের নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ মন্তব্য করেন।
বিচারকের প্রতি পাল্টা প্রশ্ন রেখে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, বিচার বিভাগ নিয়ে বহু চক্রান্ত রয়েছে। উনি (হাইকোর্টের বিচারক) কাকে লাভবান করতে এমন মন্তব্য করেছেন।
মঙ্গলবার (১০ অক্টোবর) তথ্যপ্রযুক্তি আইনের মামলায় মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানের জামিন মঞ্জুর করে আদেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে তাদের দণ্ড নিয়ে করা আপিল আবেদনটি শুনানির জন্য গ্রহণ করা হয়।
শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জামিনের বিরোধিতা করলে এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন হাইকোর্টের বিচারপতি এমদাদুল হক আজাদের একক বেঞ্চ। এক পর্যায়ে আদালত বলেন, দেশটা তো জাহান্নাম বানিয়ে ফেলেছেন।
শুনানির শুরুতে আদিলুর-এলানের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী উপস্থিত হন। এসময় রাষ্ট্রপক্ষের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. রেজাউল করিম জামিনের বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, আমাদেরও বক্তব্য আছে। তখন হাইকোর্ট বলেন, আসামিপক্ষের আইনজীবীদের আগে বলতে দিন। আপনি এখন লাফ দিয়ে উঠছেন কেন? …দেশটাকে তো জাহান্নাম বানিয়ে ফেলেছেন।
বিচারপতির এ মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ (এএম) আমিন উদ্দিনের মতামত জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, তখন আমি ওই আদালতে ছিলাম না। পরে বিষয়টি শুনেছি। পত্র-পত্রিকায়, অনলাইন সংস্করণে বিষয়টি এসেছে। তখন সংশ্লিষ্ট ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন- হ্যাঁ, আদালত এটি বলেছেন। আমি এটি শোনার পর অত্যন্ত ব্যথিত, ভারাক্রান্ত ও দুঃখিত এটা ভেবে যে, একজন বিচারক এ ধরনের মন্তব্য করতে পারেন কি না এবং একজন বিচারক যিনি সংবিধান সংরক্ষণের জন্য শপথ নিয়েছেন তিনি এমন অসাংবিধানিক কথা বলেছেন এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক এবং আমি মনে করি এর মাধ্যমে তিনি তার শপথ ভঙ্গ করেছেন।
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি জানার পর আমি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করেছি। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করে পত্রিকার কপি দিয়ে এসেছি। অবশ্যই আমি আশা করি, ‘দেশটাকে আপনারা জাহান্নামে পরিণত করে দিয়েছেন’- এ ধরনের কথা একজন বিচারক কখনো কোনো সাধারণ মানুষকে বলতে পারেন না। উনি (বিচারপতি) নিশ্চই রাজনীতি করেন না।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আর একটা কথা বলি, দেশের বিচার বিভাগ নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। বিভিন্নভাবে বিভিন্ন শ্রেণি-গোষ্ঠী বিচার বিভাগের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে যেসব কথা বলছে আমি জানি না উনি উনার (বিচারপতি) কথার মাধ্যমে কি তাদের লাভবান করতে বলেছেন কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে।
আর মাত্র পাঁচদিন পর ওই বিচারপতি অবসরে যাচ্ছেন- এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি জানি না তিনি কবে অবসরে যাচ্ছেন। কিন্তু তার এই বক্তব্য কাদের লাভবান করছে সে বিষয়টি জানতে হবে।
এদিন শুনানিতে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল রেজাউল করিম বলেন, তাদের (আদিলুর ও নাসির) বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য দেওয়া, অপপ্রচার ও গুজব ছড়ানোর অভিযোগ রয়েছে।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে আদালত বলেন, তাহলে তাদের (আদিলুর ও নাসির) কম সাজা দিলেন কেন? তাহলে তো যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া উচিত ছিল। দুই বছর দিলেন কেন?
আদালত আদিলুর ও নাসিরের আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। এরপর আদিলুর রহমান খান ও নাসির উদ্দিন এলানকে জামিন দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে তাদের ১০ হাজার টাকা জরিমানার আদেশ স্থগিত করেন।
সাজার বিরুদ্ধে আদিলুর-এলানের আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করে মঙ্গলবার (১০ অক্টোবর) হাইকোর্টের বিচারপতি মো. এমদাদুল হক আজাদের একক বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদালতে আজ জামিন আবেদনের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট এ জে মোহাম্মদ আলী, অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ রুহুল আমিন ভূঁইয়া ও মো. আহসানুজ্জামান ফাহিম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল রেজাউল করিম।
এক দশক আগে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অভিযোগে হওয়া মামলায় গত ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ এম জুলফিকার হায়াত তাদের দুই বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেন। পাশাপাশি তাদের ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে এক মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
রায়ের পর এর বিরুদ্ধে ২৫ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় আপিল ও জামিন চেয়ে আবেদন করেন তার আইনজীবী। আপিল আবেদনে সাজা বাতিল করে খালাস চাওয়া হয়। এছাড়া জারিমানার দণ্ড স্থগিত ও জামিন চাওয়া হয়। আদিলুর-এলানের কারাদণ্ড হওয়ার পর থেকেই তাদের মুক্তি জানিয়ে বিবৃতি দিয়ে আসছিল দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংগঠন।
অন্যদিকে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে করা মামলায় সর্বোচ্চ সাজা ২০ বছর এবং সর্বনিম্ন সাজা ৭ বছর হলেও তাদের দণ্ড তুলনামূলক কম হওয়ায় সাজা বাড়াতে গত ৫ অক্টোবর হাইকোর্টে আপিল আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ।