ঝাড়ু মিছিল, মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন, হাসপাতালে হামলা, কর্মবিরতি, অর্থ আত্মসাৎসহ বিভিন্ন অভিযোগে কয়েক দিন পর পর সংবাদের শিরোনাম হয় বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এ হাসপাতালের সাবেক ও বর্তমান দুই চিকিৎসকের দ্বন্দ্বে প্রায়ই অচলাবস্থা তৈরি হয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতে। ফলে তীব্র ভোগান্তিতে পড়তে হয় চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের।
সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. কামাল হোসেন মুফতি দেড় দশকের বেশি সময় ধরে একই উপজেলায় থাকায় তাঁর নিজস্ব বলয় তৈরি হয়েছে উপজেলাটিতে। আবার বর্তমান দায়িত্বে থাকা ডা. শর্মী রায়ের শ্বশুরবাড়ি মোরেলগঞ্জ পৌরসদরে হওয়ায় তাঁরও শক্ত অবস্থান রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ডা. কামাল এ হাসপাতালে যোগদান করেন ২০০৭ সালে। পরে বিভিন্ন অভিযোগে ২০২২ সালে পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ায় বদলি করা হয় তাঁকে। তবে জোর তদবিরে ওই বছরই মোরেলগঞ্জে ফিরে আসেন এই চিকিৎসক। এর পর ২০২৩ সালে তাঁকে ঢাকা ডেন্টাল কলেজে পদায়ন করা হলেও তিনি কৌশলে সেখানে না গিয়ে বাগেরহাট ম্যাটসে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে মোরেলগঞ্জেই বসবাস করছেন। সেখানে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পাশেই গড়ে তুলেছেন নিজস্ব ক্লিনিক।
অন্যদিকে ডা. শর্মী রায় মোরেলগঞ্জে যোগ দেন ২০১৪ সালে। ২০২২ সালে ডা. কামাল মোরেলগঞ্জে ফিরে আসায় তাঁকে ভাণ্ডারিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলি করা হয়। তবে শর্মীও তদবির-সুপারিশে পরের বছরই মোরেলগঞ্জে ফিরে আসেন। ডা. শর্মীও ২০১৪ সাল থেকে পৌর সদরের রাইসা ক্লিনিকে কমিশন ভিত্তিতে চাকরি করে আসছেন।
দুই চিকিৎসকের বিরুদ্ধেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন দপ্তরে একাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। তবে তারা রয়ে গেছেন সদম্ভে।
গত ২ অক্টোবর মোরেলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ঢুকে তিন চিকিৎসককে মারধর করেছে দুর্বৃত্তরা। হামলাকারীদের মধ্যে ডা. কামালের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ওষুধ কোম্পানির কর্মীও ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে ৩ অক্টোবর থেকে তিন দিনের কর্মবিরতি পালন করেন চিকিৎসক-কর্মচারীরা। কর্মবিরতির সময় চিকিৎসা নিতে আসেন রহিমা বেগম নামের পঞ্চাশোর্ধ্ব এক নারী। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে সেবা না পেয়েই ফিরে গেছেন তিনি। তিনি বলেন, ক’দিন পর পর এখানে ঝামেলা হয়, আর ভোগান্তি হয় আমাদের। হাসপাতাল বন্ধ থাকলেও ক্লিনিক ঠিক-ই খোলা থাকে।
ডা. শর্মী রায়কে আওয়ামী লীগ সরকারের দালাল আখ্যা দিয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনের সড়কে গত ১ অক্টোবর মানববন্ধন করেন স্থানীয় দুই শতাধিক নারী-পুরুষ। এ সময় জনতা ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড ও ঝাড়ু হাতে বিক্ষোভ মিছিল করেন। এর আগে ১৯ সেপ্টেম্বর একই দাবিতে মানববন্ধন করেন ভুক্তভোগীরা।
এসব কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকৃতদের দাবি, হাসপাতালের সরকারি ওষুধ না দিয়ে রেখে দেওয়া, অ্যাম্বুলেন্স সংস্কার না করে বিল তুলে নেওয়া, করোনাকালীন সময়ে স্বেচ্ছাসেবকদের টাকা আত্মসাৎ, আউটসোর্সিং কর্মীদের বেতনের টাকা না দিয়ে হয়রানি করে আসছেন ডা. শর্মী।
স্থানীয় বাসিন্দা মশিউর রহমান জানান, করোনাকালে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ৮ লাখ ৮২ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়। কিন্তু সেই টাকার বড় অংশ স্বেচ্ছাসেবকদের না দিয়ে আত্মসাৎ করেন ডা. শর্মী।
তবে ডা. শর্মী বলেন, এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন। ডা. কামাল তাঁর আত্মীয়, ক্লিনিকের লোকজন, ব্যবসায়িক অংশীদার এবং ভাড়া করা কিছু লোক দিয়ে মানববন্ধন করিয়েছেন। হাসপাতালে হামলাও ওই চিকিৎসকের ইন্ধনে হয়েছে। করোনাকালে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যাদের নাম তালিকায় ছিল, তারা টাকা পেয়েছেন বলে তাঁর দাবি।
এদিকে ডা. কামালের বিরুদ্ধে ৩ কোটি ১৭ লাখ টাকার অডিট আপত্তি রয়েছে। একজন ঠিকাদারের দুটি পে-অর্ডারের ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা ডা. কামাল হোসেন আত্মসাৎ করেছেন।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে ডা. কামাল বলেন, হাসপাতালে হামলা, ক্লিনিক ও পরিবারের লোক দিয়ে মানববন্ধন, ক্লিনিক বাণিজ্য এসব খবর ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কারও ইন্ধনে হয়তো ওই ঠিকাদার এমন অভিযোগ দিচ্ছেন। নিয়ম অনুযায়ী অডিট আপত্তির জবাবও দিয়েছেন বলে জানান তিনি।
সার্বিক বিষয়ে বাগেরহাটের সিভিল সার্জন জালাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা প্রতিটি ঘটনা পর্যালোচনা করছি। তদন্ত রিপোর্ট পেলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হবে।
Leave a comment