ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার রামচন্দ্রপুর গ্রামের ত্রিবেনী শ্মশান ঘাট এলাকায় শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) রাতে হরিণাকুণ্ডু মৎস্যজীবী লীগের নেতা জনযুদ্ধের আঞ্চলিক প্রধানসহ তিন চরমপন্থীকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করেছে প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসীরা।
নিহতদের মধ্যে রয়েছেন চরমপন্থী সংগঠন পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি এমএল জনযুদ্ধ লাল পতাকার আঞ্চলিক প্রধান ও মৎস্যজীবী লীগ নেতা হানিফ উদ্দিন ওরফে হানেফ মণ্ডল (৫৫)।
তিনি ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়নের আহাদনগর গ্রামের রাহাজ উদ্দিনের বাসিন্দা। তার শ্যালক একই উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামের উম্বাদ আলীর ছেলে লিটন মিয়া (৩৮) এবং অন্যজন হানেফের দেহরক্ষী কুষ্টিয়ার ইবি থানার পিয়ারপুর গ্রামের মৃত আরজেদ আলীর ছেলে রাইসুল ইসলাম (৩৫)।
এদিকে নিষিদ্ধ ঘোষিত চরমপন্থি সংগঠন জাসদ গণবাহিনীর কালু গ্রুপের প্রধান কমরেড কালু হোয়াটসঅ্যাপে সাংবাদিকদের মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে হত্যার দায় স্বীকার করেছেন বলে জানা গেছে।
পুলিশ জানায়, কায়েতপাড়া বাওড়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুইদল চরমপন্থি শুক্রবার দিবাগত রাত ৮টার দিকে ত্রিবেনী শ্মশান খাল এলাকায় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষ চলাকালে উভয় পক্ষের মধ্যে প্রায় ৮/১০ রাউন্ড গুলি বিনিময় হয়। এসময় গুলির শব্দে রামচন্দ্রপুর, পিয়ারপুর ও ত্রিবেনী গ্রামবাসীদের মধ্যে চরম আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে। ঘটনাস্থল শৈলকুপার ত্রিবেনী শ্মশান খাল এলাকাটি হরিণাকুণ্ডু ও শৈলকূপা এবং কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থানার মধ্যবর্তী দুর্গম বিল এলাকায় গোলাগুলির একপর্যায়ে আতঙ্কিত গ্রামবাসী পার্শ্ববর্তী শৈলকুপার রামচন্দ্রপুর পুলিশ ফাঁড়িতে খবর দেয়। পরে এলাকাবাসীর সহায়তায় পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে তিন চরমপন্থির কোপানো ও গুলিবিদ্ধ মরদেহ দেখতে পায়। এসময় সেখানে তাদের ব্যবহৃত দুটি পালসার মোটরসাইকেল ও পিস্তলের একটি ম্যাগাজিনসহ বেশকিছু গুলির খোসা উদ্ধার করে। নিহতদের সবাইকে মাথায় গুলি করে ও কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে বলে রামচন্দ্রপুর পুলিশ ফাঁড়ির আইসি মতিয়ার রহমান নিশ্চিত করেছেন।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে ঝিনাইদহ, হরিণাকুণ্ডু আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি এমএল জনযুদ্ধ ও জাসদ গণবাহিনী নামের দুটি চরমপন্থি দলের মধ্যে বিরোধ চলে আসছিল। শুক্রবার রাতে রামচন্দ্রপুর শ্মশানঘাট এলাকায় পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি এমএল জনযুদ্ধের নেতাদের গোপন বৈঠকের খবর পেয়ে যায় প্রতিপক্ষ গ্রুপ। তবে জাসদ গণবাহিনীর শীর্ষ নেতা কালুর নেতৃত্বে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে পুলিশ।
পুলিশ আরও জানায়, নিহত হানিফ মণ্ডলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় কমপক্ষে ১৩টি হত্যাসহ একাধিক মামলা রয়েছে। বিগত ২০০৩ সালের ৫ ডিসেম্বর ত্রিবেনী শ্মশান খালের ওই একই স্থানে পাঁচজনকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। নিহত জনযুদ্ধের আঞ্চলিক প্রধান হানেফ মৃত্যুদণ্ডের আসামি ছিলেন। হরিণাকুণ্ডু উপজেলার কুলবাড়ীয়া গ্রামের আলফাজ হত্যা মামলায় তার ফাঁসির আদেশ হয়। উচ্চ আদালতেও ফাঁসির রায় বহাল থাকলে স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের সময় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের বিশেষ ক্ষমায় প্রাণ ভিক্ষা পেয়ে এলাকায় ফিরে আবারও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে আসছিল হানেফ। এরপর মৎস্যজীবী লীগের হরিণাকুণ্ডু উপজেলা কমিটির সহ সভাপতি হন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পর দুর্ধর্ষ চরমপন্থি হানেফ আবারও রাজনৈতিক রঙ পাল্টে পুনরায় এলাকায় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এই ট্রিপল মার্ডারের নেপথ্যে রয়েছে চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার কায়েতপাড়া ও ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার পোলডাঙ্গা বাওড়। বাওড়টিতে বছরে কোটি টাকার ওপরে মাছের চাষ হয়।
সম্প্রতি মৎস্যজীবী লীগ নেতা পরিচয়ে হানেফ বাওড়ে মাছ ধরা ও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করলে এলাকার বিবদমান একাধিক গ্রুপের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। সেই সূত্র ধরেই হানেফসহ তার দুই সহযোগীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। কায়েতপাড়া বাওড় নিয়ে গত ৩০ বছরে অর্ধশত মানুষ খুনের শিকার হয়েছে।
এলাকাবাসীর মতে, চরমপন্থি নেতা হানেফ ইতোপূর্বে কুলবাড়িয়া গ্রামের আলফাজ, তিওরবিলা গ্রামের লুৎফর রহমান, তাহেরহুদার আব্দুল কাদের ও পোলতাডাঙ্গার ইজাল মাস্টারসহ প্রায় ১০-১২ জনকে গুলি করে ও গলাকেটে হত্যা করে বলে অভিযোগ রয়েছে। এরমধ্যে ইজাল মাস্টারকে হত্যার পর তার মাথা কেটে ফুটবল খেলেছিল হানেফ। সেসময় বিষয়টি দেশে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।
অন্যদিকে দীর্ঘদিন পর চরমপন্থিদের মধ্যে হানাহানি ও গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে হত্যার দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেওয়া নিয়ে এলাকায় জনমনে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে।
জানা গেছে, একই স্থানে ২০০৩ সালের ৫ ডিসেম্বর শৈলকুপার শেখপাড়া গ্রামের শহীদ খাঁ, ত্রিবেনী গ্রামের শাহনেওয়াজ, একই গ্রামের ফারুক, নুরু কানা ও কুষ্টিয়ার ভবানীপুর গ্রামের কটাকে গুলি ও গলাকেটে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এই মামলায় ২০২৪ সালের ২৯ অক্টোবর কুষ্টিয়ার আলী রেজা ওরফে কালু ও কুষ্টিয়ার ইবি থানার পিয়ারপুর গ্রামের মহসিন আলীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ঝিনাইদহ জেলা জজ দ্বিতীয় আদালতের বিচারক মো. জাকারিয়াহ এই দণ্ডাদেশ দেন।
অপরদিকে শৈলকূপা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাসুম খান জানান, বিভিন্ন এলাকায় আধিপত্য নিয়ে এ হত্যার ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তিনটি মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঝিনাইদহ সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠিয়েছে।
এ ঘটনায় পুলিশ এখনো পর্যন্ত কাউকে আটক করতে পারেনি। তবে শৈলকূপা থানায় মামলার প্রস্তুতি চলছে বলে তিনি জানান।
অপরদিকে হানিফ নিহতের ঘটনায় হরিণাকুণ্ডু, চুয়াডাঙ্গা ও আলমডাঙ্গাসহ বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ মানুষের মাঝে স্বস্তির নিশ্বাস ফিরেছে যেমন, তেমন অন্যদিকে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
নিহত হানেফের ভাই হরিণাকুণ্ডু উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান সাজেদুল ইসলাম ইসা জানান, আমার ভাই সারাদিন মাঠে রসুন ক্ষেতে কাজ করছিল। বিকেলে আমার ভাইয়ের মোবাইল ফোনে একটা কল আসে। পরে বাড়িতে এসে গোসল করে মোটরসাইকেলে করে তার শ্যালক লিটনকে সঙ্গে নিয়ে চলে যায়। পরে রাতে সংবাদ পেলাম আমার ভাই হানেফকে গুলি ও কুপিয়া হত্যা করা হয়েছে। যারা আমার ভাইকে হত্যা করেছে আমি তাদের বিচার চাই।