জিনাত আরা আহমেদ
খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার মতো তথ্যের অধিকার নাগরিকের অন্যতম মৌলিক অধিকার। এই অধিকার সুরক্ষায় সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বর্তমান সময়ে কাজের ক্ষেত্রে তথ্যের অধিকার মানুষের নিয়মিত চাহিদা। এর সাথে সুশাসনের সম্পর্ক, এটা মানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকার। দাপ্তরিক নানা কাজে নাগরিকদের বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী সংস্থায় যেতে হয়। দপ্তরভেদে সঠিক ও নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরন করে আবেদন সম্পন্ন করতে হয়। এরপর নির্ধারিত অফিসে কাজের ধরণ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয় আইনানুগ পদ্ধতিতে। দাপ্তরিক কার্যক্রম সমাধানে শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব নাগরিকের জন্য একই পদ্ধতি অনুসরণীয়। কিন্তু সহজ সমাধান সবক্ষেত্রে পাওয়া যায় না, ভোগান্তির শিকার হন অনেকেই। এক্ষেত্রে যেটা একমাত্র রক্ষাকবচ সেটা হল সঠিক তথ্য জানা।
সঠিক তথ্য জানলে মানুষ সেই অনুযায়ী আবেদন করতে পারবে। তথ্য জানা থাকলে কোন দপ্তরে সেবা পেতে কত টাকা জমা দিতে হবে তা জানবে। কতদিনের মধ্যে চাহিত তথ্য পাওয়া যাবে তা জানলে, তিনি কারণ জানতে চাইবেন। আরো বিশদ জানতে চাইলে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জেনে নেবেন। কিন্তু তথ্য না জানায় সাধারণ মানুষ অনেক ক্ষেত্রেই হয়রানীর শিকার হন। বিধি-বিধান মেনে দাপ্তরিক কাজ সমাধানে নাগরিকরা কিছু বিশেষ কারণে প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েন। প্রথমত সাধারণ মানুষের অনেকেই বিধি-বিধান সম্পর্কে সচেতন নন। এই সুযোগ নিয়ে কিছু সুবিধাবাদী লোক মানুষকে জিম্মি করে ফায়দা নিতে চায়। যেমন: টাকা পয়সার বিনিময়ে কাজ করে দেয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। কখনোবা দ্রুততম সময়ের মধ্যে কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা আদায় করে। সবক্ষেত্রেই লক্ষণীয় বিষয় হলো, মানুষের প্রয়োজন যেখানে বেশী অর্থ্যাৎ যেটা বেশী জরুরী সেখানেই কিছু সুযোগ সন্ধানী মানুষ ব্যক্তিস্বার্থে সাধারণ মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলে। তাই নাগরিক স্বার্থ সুরক্ষায় সরকার কিছু আইন ও বিধি জারী করেছেন, যার সাহায্যে লিখিত আবেদনের মাধ্যমে নাগরিক তার প্রাপ্য অধিকার আদায় করতে পারবেন।
নাগরিক অধিকার সুরক্ষায় বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে যে বিশেষ আইন প্রণয়ন করেছেন, তা হলো ‘তথ্য অধিকার আইন’। দুর্নীতিরোধে নাগরিকের সরাসরি হস্তক্ষেপ তথা জবাবদিহিতামূলক প্রশাসনের অঙ্গীকারে এই আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এ আইনের মূল উদ্দেশ্যই হলো জনগণের ক্ষমতায়ন। এটি তথ্য আদায়ে নাগরিক অধিকার অর্জনের হাতিয়ার। যে কোন সরকারী-বেসরকারী, স্বায়ত্তশাসিত কিংবা আইনানুযায়ী সৃষ্ট সংস্থায় জনগণ তার প্রয়োজনীয় তথ্যের জন্য আবেদন করলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তথ্য দেয়া আইনে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তথ্য না পেলে, আদৌ তথ্য না পেলে কিংবা অসত্য বা অসম্পূর্ণ তথ্য দেয়া হলে তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন। আপিল কর্তৃপক্ষ হবেন, নির্ধারিত সংস্থার পরবর্তী উর্ধ্বতন অফিসের প্রশাসনিক প্রধান। তথ্য না পেয়ে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করবেন এবং আপিল কর্তৃপক্ষ ১৫ দিনের মধ্যে তার সমাধান দিবেন। আপিল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ হলে ৩০ দিনের মধ্যে তথ্য কমিশনে আপিল করতে পারবেন।
সরকারি প্রতিষ্ঠানকে জনবান্ধব করে তুলতে বর্তমান সরকারের নীতি ও কর্মপরিকল্পনায় বিভিন্ন সময়ে নানা পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছে। যে কোন প্রতিষ্ঠানকে সেবামূলক করতে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সততা ও কর্মনিষ্ঠা প্রধান ভূমিকা পালন করে। ব্যক্তি মানুষের নীতি, আদর্শ, ব্যক্তিত্ব, চরিত্রবল সরকারি বিধিবিধানের প্রতি আন্তরিক থাকার পাশাপাশি দায়িত্ব পালনে কর্তব্যনিষ্ঠ করে তোলে। তাই এবিষয়ে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে সরকার ‘জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল’ প্রণয়ন করেছেন। নিয়মিত সভা করে প্রতিটি অফিসে কর্মচারীদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। আর এক্ষেত্রে কর্মচারীদের সততার মূল্যায়নেও রয়েছে বিশেষ প্রণোদনা।
সরকারি অফিসের সেবা সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য জনগণের কাছে সহজবোধ্য করার একটি নির্ভরযোগ্য উপায় ‘সিটিজেন চার্টার’। প্রত্যেক দপ্তরে সিটিজেন চার্টার প্রদর্শন বাধ্যতামূলক। সিটিজেন চার্টারের মাধ্যমে দাপ্তরিক কাজের ধরণ ও সেবাপ্রাপ্তির খুঁটিনাটি বিষয়ে জনগণ সরাসরি জানতে পারে। এতে নির্দিষ্ট অফিসের সেবা কার্যক্রম এবং পদ্ধতিগত বিষয় দর্শনীয় স্থানে প্রকাশ করার মাধ্যমে সেবা সহজিকরণ করা হয়েছে।
নাগরিক সেবায় জনগনের আস্থা অর্জনে ‘অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থা’ নামে আরেকটি বিষয় যুক্ত হয়েছে প্রতিটি সরকারি অফিসে। এর মাধ্যমে দাপ্তরিক সেবার মান কিংবা পণ্য সম্পর্কে অভিযোগ জানানো যাবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে। শুধু নাগরিক নয় বরং অন্য কোন দপ্তর অথবা উক্ত অফিসে কর্মরত কিংবা পেনশনভোগী কর্মচারীও তার অভিযোগ জানাতে পারবেন নির্দিষ্ট ফরমে আবেদনের মাধ্যমে। নিয়ম অনুযায়ী দপ্তরের অভিযোগ নিষ্পত্তি কর্মকর্তা (অনিক) অভিযোগ তদন্তে ব্যবস্থা নিবেন। এক্ষেত্রেও আপিলের সুযোগ রয়েছে। আপিল কর্মকর্তা হবেন সংশ্লিষ্ট দপ্তরের পরবর্তী উর্ধ্বতন দপÍরের অনিক। মন্ত্রণালয় বা বিভাগের আপিল কর্মকর্তা হবেন একজন অতিরিক্ত সচিব অথবা অনিকের জ্যেষ্ঠ যুগ্মসচিব।
জনগণের সাথে সরকারি অফিসের পারস্পরিক সম্পর্কন্নোয়নে প্রতিটি অফিসে গণশুনানীর জন্য সপ্তাহে একদিন ধার্য্য করা হয়েছে। নির্ধারিত দিনে যেকোন ব্যক্তি যেকোন সরকারি অফিসে তার প্রয়োজনের বিষয় অফিস প্রধানের কাছে জানাতে পারবেন। তাছাড়া বিষয়টি যদি অন্য অফিস সংশ্লিষ্টও হয় তথাপি ঐ কর্মকর্তা নির্দিষ্ট অফিসে তার বিষয়টিতে সুপারিশ করতে পারবেন।
এখন সব অফিসে চালু হয়েছে স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে নিয়মিত সভা। এর উদ্দেশ্য হলো সরকারি সেবার সাথে সংশ্লিষ্ট সেবাপ্রার্থীদের মতামত গ্রহণ করে সেবা সহজিকরণ এবং দ্রুততার সাথে মানসম্মত সেবা দিতে কর্মচারীদের উদ্বুদ্ধ করা। স্টেকহোল্ডরদের সাথে পারস্পরিক মতবিনিময়ের ফলে কর্মচারীগণ সেবা প্রদানে নৈতিকভাবে এক প্রকার বাধ্যবাধকতায় আবদ্ব হন, যা সরকারি অফিসের ভাবমূর্তি উন্নয়নে ভূমিকা রাখে।
সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়ন এবং তাদের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন দপ্তরে অসংখ্য কর্মসূচি চলমান রয়েছে। সরকারি সেবা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমেই শেখ হাসিনা সরকারের উন্নয়নের কথা জনে জনে পৌঁছে যাবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানকে দূর্নীতিমুক্ত ও জবাবদিহিমূলক করতে অসংখ্য সুব্যবস্থা থাকার পরও সবক্ষেত্রে দূর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি। ব্যক্তি মানুষের অবহেলায় অনেক সেবাপ্রার্থী সঠিক সেবা থেকে বি ত হন। অথচ সরকারের সকল উন্নয়নের মূল লক্ষ্যই হল জনগণের কল্যাণ, মানুষের ভোগান্তি নিরসন। সরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা সরকারের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকে ম্লান করে দেয়। এক্ষেত্রে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে প্রয়োজন কেন্দ্রীয়ভাবে নিবিড় পর্যবেক্ষণ।

লেখক : জিনাত আরা আহমেদ
উপপ্রধান তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস,খুলনা।