জীবজগতের হাজার হাজার প্রজাতির প্রতি মানুষের কৌতূহলের সীমা নেই। কেমন করে বেঁচে থাকে এসব প্রাণি, তাদের জীবনযাপন কিংবা জীববৈচিত্র্য রায় তাদের ভূমিকা ইত্যাদি বিচারে মানুষের কৌতূহলের ধরন থাকে ভিন্ন।
জীবিত প্রাণিগুলোকে নিয়ে মানুষের আগ্রহ এবং শিক্ষার পাশাপাশি বিলুপ্ত প্রাণি সম্পর্কে জানার চেষ্টাও আছে মানুষের মধ্যে। বিশেষ করে বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান-শিক্ষার্থীদের। সেরকম একটি প্রাণি হলো ডাইনোসর। পৃথিবীতে মানুষের জন্মের বহুকাল আগে বিলুপ্ত এই অতিকায় প্রাণিদের সম্পর্কে বলা যায় মানুষের আগ্রহ এখনো তুমুল।
Dinosaur শব্দের অর্থ ভয়ঙ্কর টিকটিকি (Terrible Lizard)। সরীসৃপ শ্রেণির এই ভয়ঙ্কর প্রাণি পৃথিবীতে বাস করত মোটামুটি ২৪ কোটি বছর থেকে সাড়ে ৬ কোটি বছর আগে। প্রকৃত অর্থে Jurassic Period-ই ছিল ডাইনোসরদের রাজত্বকালে। সে সময় অন্যান্য প্রাণির বিকাশ ঘটলেও এর দাপটে অনেক প্রজাতিই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। ১৮৪১ সালে প্রাপ্ত ডাইনোসরের বেশ কিছু ফসিল (জীবাশ্ম) নামকরণের সময় স্যার রিচার্ড ওয়েন এই নামকরণ করেছিলেন।
ধারণা করা হয়, একসময়ে উত্তর মেরু ছাড়া সমগ্র পৃথিবীতেই ডাইনোসরের রাজত্ব ছিল। জলে, স্থলে, আকাশে, বিভিন্ন ধরনের ডাইনোসরের অবাধ বিচরণ ছিল। আজকের পৃথিবীতে যেমন মানুষের রাজত্ব, তেমনি একসময় এ পৃথিবী ছিল ডাইনোসরদের পৃথিবী।
বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায়, অধিকাংশ ডাইনোসরের চারটি পা ছিল। কেউ কেউ চার পায়ে হাঁটত, আবার কেউ দু পায়ে, আর সামনের পা দুটো হাতের মতো ব্যবহার করত। কিছু ডাইনোসর আকাশে পাখির মতো উড়ত, আবার কেউ কেউ পানিতে বিচরণ করত।
আকার-আকৃতির দিক থেকেও ছিল ভিন্নতা। যেমন : Argentinesaurus, Senismosaurus, Ultrasauros , Brachiosaurs, Supersaurus– এগুলো ছিল রীতিমতো দানবাকৃতির। এগুলোর দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় ১০০ ফুট, উচ্চতা প্রায় ৫০ ফুট। আবার Compsognathus ছিল মুরগির আকারের। কোনও প্রজাতি ছিল হিংস্র-মাংশাসি, কোনও প্রজাতি ছিল তৃণভোজী। আবার অনেক প্রজাতি ছিল, যারা একই সাথে উদ্ভিদভোজী এবং মাংসভোজী ছিল।
স্টিভেন স্পিলবার্গের ‘জুরাসিক পার্ক’ চলচ্চিত্রটিতে আমরা দেখেছি বিভিন্ন ধরনের ডাইনোসর, তাদের গায়ের রঙ, তাদের আওয়াজ। তবে সবই কাল্পনিক, এখনকার মানুষের ধারণা। আজকের দিনে যদি ডাইনোসরদের আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসা হয়, তাহলে চিত্রটা কেমন হবে, ভাবলেই আমাদের গা শিউরে উঠে। কিন্তু একসময় পৃথিবী দাপিয়ে বেড়ানো এই ভয়ঙ্কর প্রাণিটা কেন আজ বিলুপ্ত, বিজ্ঞানীদের গবেষণায় এর বেশ কিছু কারণ জানা গেছে। আসুন এমন ১১টি কারণ সম্পর্কে জেনে নিই :
১. খাদ্য হিসেবে ডাইনোসরের বিলুপ্তি
একসময় সব মাংসাশি ডাইনোসর সব উদ্ভিদভোজী ডাইনোসরদের খেয়ে ফেলে। পরে খাদ্যের অভাবে মাংসাশি ডাইনোসরদেরও বিলুপ্তি হয়।
২. উল্কাপাত
একসময় মার্কিন বিজ্ঞানীরা যুক্তরাষ্ট্রের আরিজোনায় ফাগস্টাকে একটি বিশাল গর্ত আবিষ্কার করেন এবং যেখানে উল্কাখন্ডের সন্ধান পান। ধারণা করা হয় এই উল্কাখন্ড পৃথিবীতে আছড়ে পড়ার ফলে সমগ্র পৃথিবী ধূলা এবং জলীয় মেঘে ঢেকে গিয়েছিল। এর ফলে সূর্যকিরণ পৃথিবীতে পৌঁছাত না। এতে অনেক সবুজ উদ্ভিদের বিলুপ্তি ঘটে। আর খাদ্যের অভঅবে উদ্ভিদভোজী ডাইনোসরগুলোরও মৃত্যু হয়।
৩. তাপমাত্রার পরিবর্তন
জীবজগতে সরীসৃপ প্রাণিদের তাপমাত্রার সাথে অভিযোজন করার মতা সবচেয়ে কম, যার প্রভাব পড়েছিল ডাইনোসরদের ওপরেও। মহাদেশগুলোতে বিচিত্র তাপমাত্রাগত পার্থক্যের কারণে ডাইনোসরগুলো বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। ছোট প্রজাতির সরীসৃপরা পাহাড়-পর্বতের গুহায় আশ্রয় নিতে পারলেও বিশালদেহী ডাইনোসরগুলো ছিল অসহায়।
৪. খাদ্যভাব
মহাদেশগুলো যখন বিচ্ছিন্ন হচ্ছিল, তখন তাপমাত্রা, বায়ুপ্রবাহ, বৃষ্টিপাতের আধিক্য বা অনাবৃষ্টি, তুষারপাত ইত্যাদির বিচারে পরিবেশ পাল্টে যাচ্ছিল। ফলে প্রাণিজগতের বিভিন্ন প্রজাতি যেমন লোপ পাচ্ছিল, তেমনি বহু প্রজাতির উদ্ভিদও বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। এর ফলে উদ্ভিদভোজী প্রাণিদের খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছিল প্রবলভাবে। বিশেষ করে উদ্ভিদভোজী ডাইনোসরগুলো এর শিকার হয়েছিল প্রথম। তাপমাত্রাগত পরিবর্তনে এরা কাহিল হয়ে পড়েছিল, সেই সাথে পর্যাপ্ত খাদ্য না পাওয়ার কারণে এদের বিলুপ্তি ঘটেছিল। অন্যদিকে মাংসাশি ডাইনোসরগুলো তাপমাত্রা এবং খাদ্য হিসেবে উদ্ভিদভোজী প্রাণির অভাবে মারা গিয়েছিল একটু বিলম্বে।
৫. রোগব্যাধি
সনাতন পরিবেশ যখন সুস্থ-সবল ডাইনোসরগুলো বিচরণ করত তখন তাদের ওপর ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসগুলো হয়তো ততটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। বহু কারণে ধীরে ধীরে ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসদের আক্রমণ করার মতাও বৃদ্ধি পেয়েছিল। সব মিলিয়ে ডাইনোসরগুলো রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছিল দ্রুত। এভাবে তাদের বিলুপ্তি ঘটছিল।
৬। প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস
সাধারণত দেখা যায় দীর্ঘকাল অনুকূল পরিবেশ না পেলে কোনও কোনও প্রজাতির যৌনস্পৃহা বা প্রজননক্ষমতা হ্রায় পায়। ডাইনোসরের কোনও কোনও প্রজাতি এই কারণেই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।
৭. বিবর্তন
প্রতিকূল পরিবশেকে জয় করে যেসব ডাইনোসর টিকে যেতে সক্ষম হয়েছিল, ধারণা করা যায় দেহগত বিবর্তনের ধারায় তারা অন্যজাতীয় প্রাণিতে পরিণত হয়ে গিয়েছিল।
৮. বিষাক্ত গাছ
একসময় বিষাক্ত গাছে পৃথিবী ছেয়ে গিয়েছিল। উদ্ভিদভোজী ডাইনোসরগুলো এসব গাছ খেয়ে মৃত্যুবরণ করার পর, মাংসাশি ডাইনোসরগুলোও খাদ্যভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
বিষাক্ত গাছ ধারণায় বিরুদ্ধে যুক্তি : এই যুক্তিটি গ্রহণযোগ্য নয়, এই জন্য যে, পৃথিবীর সব গাছ বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল এমন হওয়াটা স্বাভাবিক নয়।
৯. স্থূল শরীর
উদ্ভিদভোজীরা অত্যধিক খাবার খেয়ে খেয়ে এত মোটা হয়ে গিয়েছিল যে এরা এক সময় চলাফেরা করতে অম হয়ে মাংসাশি ডাইনোসরদের সহজ শিকারে পরিণত হয়েছিল।
১০. তুষার যুগের আবির্ভাব
পৃথিবীতে অকস্মাৎ তুষার যুগের আবির্ভাব ঘটায় সব ডাইনোসর ঠান্ডায় জমে মৃত্যুবরণ করে।
১১. ক্রম অগ্ন্যুৎপাত
পৃথিবীজুড়ে আগ্নেয়গিরিগুলো ধারাবাহিকভাবে অবিরত বিষাক্ত গ্যাস ও লাভা নিপে করতে থাকে। ফলে ডাইনোসরগুলোর বিলুপ্তি হয়।