চুল দাড়ি রাঙাতে মানুষ খেজাব বা কলপ ব্যবহার করে। কেউ ব্যবহার করে কালো রঙ, কেউবা মেহেদি। যে পদ্ধতি বা যে রঙই ব্যবহার করা হোক না কেন, ব্যবহারের আগে মুসলমানের জেনে নেওয়া উচিত ইসলামের দৃষ্টিতে কোনটা বৈধ। নিচে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
কলপ ব্যবহার জায়েজ
চুল-দাড়ি পেকে গেলে তাতে খেজাব বা কলপ ব্যবহার বৈধ। মেহেদি বা এ ধরণের রঙের কোনো জিনিস দিয়ে চুল-দাড়ি রাঙাতে উৎসাহ দিয়েছেন নবীজি। হজরত আবু উমামা বাহেলি (রা.) বলেন, একদা রাসুল (স.) আনসারি বৃদ্ধ সাহাবিদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, যাদের দাড়ি সাদা হয়ে গিয়েছিল। তাদের দেখে তিনি বললেন, ‘হে আনসারের দল! তোমরা দাড়িকে লাল ও হলুদ রঙে রঞ্জিত করো এবং আহলে কিতাবদের বিরোধিতা করো।’ (তাবারানি কাবির: ৩১৬; সহিহাহ: ২১১৬; সহিহুল জামে: ৪৮৮৭)
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, নবী (স.) বলেছেন, ইহুদি ও নাসারারা খেজাব লাগায় না। অতএব তোমরা তাদের বিপরীত করবে’। (বুখারি:৫৮৯৯; মুসলিম:২১০৩; মেশকাত: ৪৪২৩)
আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী (স.) চামড়ার জুতো পরিধান করতেন এবং অর্স তথা লাল গোলাপের রস ও জাফরান দিয়ে দাঁড়িটুকু হলুদ করে নিতেন।’ (আবু দাউদ: ৪২১০)
কালো কলপ নাজায়েজ
চুল দাড়িতে মেহেদি জাতীয় রঙ ব্যবহার জায়েজ হলেও কালো কলপ ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন নবীজি (স.)। হজরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, মক্কা বিজয়ের দিন নবীজি (স.) হজরত আবুবকরের পিতা আবু কুহাফার (রা.)-এর চুল-দাড়ি পাকা দেখে তাকে বললেন, ‘এটাকে কোনো কিছু দ্বারা পরিবর্তন করো। তবে কালো থেকে বিরত থাকো।’ (সহিহ মুসলিম: ৫৪৬৬)। এ হাদিসে কালো খেজাব ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে।
যারা চুল-দাড়িতে কালো রঙ ব্যবহার করবে তারা জান্নাত থেকে বঞ্চিত হবে, আবার জান্নাতের ঘ্রাণ পাবে না বলেও সতর্ক করেছেন মহানবী (স.)। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন—
‘শেষ যুগে এমন এক সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটবে যারা (চুল-দাড়িতে) কবুতরের বুকের রঙের মতো কালো খেজাব বা কলপ ব্যবহার করবে। তারা জান্নাতের সুগন্ধও পাবে না।’ (আবু দাউদ: ৪২১২)
কেমিক্যালযুক্ত কালো মেহেদি ব্যবহার নাজায়েজ
কেমিক্যালযুক্ত যে মেহেদির রঙ সম্পূর্ণ কালো সেটার নাম মেহেদি হলেও তা ব্যবহার নাজায়েজ। তবে কোনো খেজাব যদি একেবারে কালো না হয়ে মিশ্র রঙের হয়, তা ব্যবহার করা যেতে পারে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আল্লাহর সৃষ্টির কোনো পরিবর্তন নেই’ (সুরা রূম: ৩০)। অর্থাৎ প্রকৃতিগতভাবে আল্লাহর কোনো সৃষ্টিকে পরিবর্তন সাধন করা নিষেধ। সাদা কিংবা কালো চুল-দাড়িও প্রকৃতিগতভাবে আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি। তাই তা পরিবর্তন হারাম। তবে কিছু রঙের ব্যাপারে রাসুল (স.) বলেন—
‘নিশ্চয় সর্বশ্রেষ্ঠ বস্তু যা দিয়ে বার্ধক্যের সাদা বর্ণকে পরিবর্তন করা যায়, তা হচ্ছে মেহেদি ও কাতাম; যার ফল মরিচের ন্যায়।’ (আবু দাউদ: ৪২০৫; নাসায়ি: ৫০৮০)
সাদা চুল-দাড়ির মর্যাদা
বার্ধক্যজনিত কারণে চুল-দাড়ি পেকে গেলে তাতে অসম্মানের কিছু নেই, বরং সম্মান বাড়ে, গুনাহ ঝরে যায়। তাই চুল-দাড়িকে কালো করে নিজেকে যুবক কিংবা অপেক্ষাকৃত কম বয়সী জাহির করার মধ্যে সার্থকতা নেই। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (স.) বলেন—
‘তোমরা পাকা চুল তুলে ফেলো না। কেননা পাকা চুল হলো মুসলমানের জ্যোতি। কোনো মুসলমানের একটি চুল পেকে গেল আল্লাহ তার জন্য একটি নেকি লিখে দেন, একটি মর্যাদা বৃদ্ধি করেন, একটি গুনাহ ক্ষমা করেন।’ (মুসনাদে আহমদ: ৬৯৬২)
অসুস্থতাজনিত সাদা হওয়া চুল-দাড়ির ক্ষেত্রে
কালো খেজাব ব্যবহারে নিষেধের মূল কারণ হলো, এর দ্বারা আল্লাহপ্রদত্ত বার্ধক্যকে গোপন করে নিজেকে তরুণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। ফলে ব্যক্তিগত আচরণেও এর প্রভাব পড়ে। এটা এক ধরণের প্রতারণা। আল্লাহর ফায়সালাকে মেনে না নেওয়ার নামান্তর।
তবে অসুস্থতা, চুলের যত্ন না নেওয়া, কোনো ওষুধ ব্যবহারের কারণে বা অন্য কোনো কারণে অপরিণত বয়সেই যে যুবকের চুল-দাড়ি সাদা হয়ে গেছে, তার কালো খেজাব ব্যবহার বৈধ বলে অনেক আলেম মত দিয়েছেন। যেহেতু সে আসলে বৃদ্ধ নয়, তাই বার্ধক্য গোপন করা হচ্ছে না।’ (ফয়জুল কাদির: ১/৩৩৬)।
বার্ধক্যের আগেই সাদা হয়ে যাওয়া চুলে কোনো কোনো পূর্ববর্তী আলেমও কালো খেজাব ব্যবহার করেছেন। ইমাম জুহরি (রহ.) বলেন, আমাদের চেহারা যখন সতেজ ছিল তখন আমরা কালো খেজাব ব্যবহার করেছি। কিন্তু যখন চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ পড়েছে, চেহারা মলিন হয়ে গেছে, দাঁত নড়বড়ে হয়ে গেছে তখন আর কালো খেজাব ব্যবহার করিনি। (ফাতহুল বারি: ১০/৩৩৬)।
সতর্কতা বাঞ্ছনীয়
যেহেতু হাদিসে কালো খেজাবকে বিশেষভাবে নিষেধ করা হয়েছে তাই যুবকদের জন্য উচিত এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করে একেবারে কালো খেজাব ব্যবহার না করে লাল কালো মিশ্রিত খেজাব ব্যবহার করা। (তুহফাতুল অহওয়াজি: ৫/১৫৪)।
নারীর ক্ষেত্রেও পুরুষের মতোই বিধান। চুল-দাড়িতে নারী-পুরুষ উভয়ে মেহেদি ব্যবহার করতে পারবেন। পুরুষের জন্য শরীরের অন্য কোথাও রঙ লাগানোর অনুমতি নেই, তাই তারা শুধু চুল-দাড়িতেই লাগাবেন। কিন্তু নারীরা হাত-পাসহ শরীরের অন্যান্য অঙ্গেও মেহেদি লাগাতে পারবেন।
উল্লেখ্য, কালো রঙ দিয়ে কলপ বা খেজাব লাগানোর যে হাদিস বলা হয়, তা সবই জাল। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কলপ ব্যবহারে সতর্ক হওয়ার এবং ইসলামি বিধান মানার তাওফিক দান করুন। আমিন।
পি এস/এন আই