গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া শুরু করেছে কোম্পানিগুলো, ইতোমধ্যে দু’টি কোম্পানির প্রস্তাব এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) জমা পড়েছে। প্রস্তাব দু’টি বিধিসম্মত না হওয়ায় ফেরত পাঠানো হচ্ছে বলে নিশ্চিত করেছেন বিইআরসি চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল।
বিইআরসি চেয়ারম্যান কোনো কোম্পানির নাম উল্লেখ না করে বলেন, দু’একটি আবেদন এসেছে ট্যারিফ পরিবর্তনের জন্য। সেগুলো আইন ও বিধি অনুযায়ী যথাযথ না হওয়ায় ফেরত পাঠানো হচ্ছে। তাদেরকে বিধিমোতাবেক আবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
কমিশনের অপর একটি সূত্র দাবি করেছে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি ও জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম লিমিটেডের আবেদন জমা পড়েছে। জালালাবাদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী শোয়েব আহমেদ মতিন বলেছেন, ট্যারিফ পরিবর্তনের প্রস্তাব প্রক্রিয়াধীন, আবেদনটি কোথায় কি অবস্থায় আছে বলতে চাই না। এই মুহূর্তে এর চেয়ে বেশি মন্তব্য করা সম্ভব নয়।
পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) মোহাম্মদ সোলাইমান গাজী ট্যারিফ পরিবর্তনের প্রস্তাব বিইআরসিতে পাঠানোর কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, এই মুহূর্তে এরচেয়ে বেশি কিছু জানাতে পারবো না। বিইআরসি বাতিল করেছে এ সংক্রান্ত কিছু জানা আছে কিনা। এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, এখন পর্যন্ত বিষয়টি আমার জানার বাইরে। দর কত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে সে বিষয়ে কিছু জানাতে অস্বীকৃতি জানান সোলাইমান গাজী।
এলএনজির (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) দাম বেড়েই চলছে, অক্টোবরের দরপত্রে ৩৫ দশমিক ৮৯ ডলারের (এমএমবিটিইউ) যোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছে। নতুন টেন্ডারে সর্বনিম্ন দর জমা পড়েছে ৫০ ডলার। আগের দরে চলতি অর্থবছরে ক্রয় বিক্রয়ের মধ্যে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। নতুন দরে এলএনজি আনলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার আমদানি না করেই ও কোনো বিকল্প নেই। ১ হাজার এমএমসিএফডি আমদানি করেও শতভাগ যোগান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। আমদানি কমিয়ে দিলে গ্যাস সংকট চরম আকার ধারণ পারে, বন্ধ হয়ে যাবে বিদ্যুৎ কেন্দ্র, শিল্প ও সার কারখানা।
জ্বালানি বিভাগ চায় ভর্তূর্কি বাড়াতে। কিন্তু অর্থ বিভাগ সাফ জানিয়ে দিয়েছে ভর্তূকি বাড়ানো সম্ভব না। বাজেট বরাদ্দ সাড়ে ১২ হাজার কোটির টাকার বাইরে অর্থ দেওয়া সম্ভব না। নিজেদের তহবিল থেকেই সমন্বয় করতে হবে। সে কারণে এখন দাম বাড়ানো ছাড়া কোনো গত্যন্তর দেখছে না জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। গ্যাসের পাইকারি দর অথাৎ বিতরণ কোম্পানির ক্রয় দর বরাবরেই মন্ত্রণালয় নির্ধারণ করে আসছে। আর গ্রাহক পর্যায়ের দর বিইআরসি নির্ধারণ করে থাকে। সে কারণে কোম্পানিগুলো দাম বাড়ানোর তোড়জোড় শুরু করেছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের মাধ্যমে গণশুনানি ছাড়া বিশেষ আদেশের মাধ্যমে করা যায় কিনা সেটাও ভেবে দেখা হচ্ছে।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে গত নভেম্বরে অর্থবিভাগের কাছে ৯ হাজার ৩৩১ কোটি টাকার ভর্তুকি বাবদ চাওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন অবধি মাত্র এক হাজার কোটি টাকা পাওয়া গেছে। গত ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জ্বালানি বিভাগের সমন্বয় সভায় শিল্প এবং বিদ্যুৎ উপাদনে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির পরামর্শ দিয়েছেন।গত ২৮ ডিসেম্বর জ্বালানি সচিব আনিছুর রহমান (বর্তমানে অবসর উত্তর ছুটিতে রয়েছেন) স্বাক্ষরিত একটি কার্যপত্রে বলা হয়েছে, অর্থ বিভাগ থেকে ভর্তুকির অর্থছাড়ের চেষ্টা করতে হবে।
গ্যাসের সংকট মোকাবিলায় বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানির প্রক্রিয়াটি শুরু থেকেই ব্যাপক সমালোচিত। কাতার ও ওমান থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে আনা এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশন করা হচ্ছিল মহেশখালীতে অবস্থিত দুটি এফএসআরইউ (ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট) দিয়ে। মুরিং পয়েন্ট ছিঁড়ে যাওয়ায় একটি এফএসআরইউ এখন বন্ধ রয়েছে। অন্যদিকে কাতার ও ওমান জানিয়েছে, আগামী বছর এলএনজির সরবরাহ কমিয়ে দেবে দেশ দুটি। এ কারণে দিশেহারা জ্বালানি বিভাগ, টেন্ডার করেও যোগ্য ঠিকাদার ধরতে পারছে না।
এলএনজির বিকল্প হতে পারতো দেশীয় তেল-গ্যাসের অনুসন্ধান জোরদার করা। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই বিষয়টি রয়ে গেছে অবহেলিত। ১৯৯৫ সালের জ্বালানি নীতিমালায় বছরে ৪টি অনুসন্ধান কূপ খননের কথা বলা হলেও কোনো সরকারেই তা মেনে চলেনি। বাংলাদেশ ভূখণ্ডে স্বাধীনতার পর মাত্র ৪০টি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে, একই সময়ে ত্রিপুরা তার স্বল্প আয়তনে কূপ খনন করেছে ১৬০ টি। ত্রিপুরা ১৬০টি কূপ খনন করে মাত্র ১১টি গ্যাস ফিল্ড আবিষ্কার করেছে। বাংলাদেশ সীমানায় প্রথম কূপ খনন করা হয় ১৯১০ সালে। বর্তমান সময় পর্যন্ত (১১০ বছরে) ৯৫টি কূপ খননের মাধ্যমে ২৮টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছে। এর বাইরে রয়েছে মোবারকপুর ও কশবার মতো কয়েকটি ফিল্ড। যেগুলোতে গ্যাসের আঁধার পেলেও বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য নয় বলে ঘোষণা করা হয় নি।
তবে বর্তমান সরকার এ ক্ষেত্রে সাধুবাদ পাওয়ার দাবি রাখে। তারা অনুসন্ধান কূপ খননের পাশাপাশি ব্যাপক ভিত্তিক কর্মযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে ৪০টি কূপের মধ্যে বর্তমান সরকারের ১১বছরে প্রায় অর্ধেক অর্থাৎ ১৯টি কূপ খনন কাজ সম্পন্ন করেছে। বঙ্গবন্ধু সরকার তার সাড়ে তিন বছরে সময়ে ৯টি কূপ খনন করেছিলেন। এর মধ্যে অফসোরে (সাগরে) ৭টি এবং মূল ভূ-খণ্ডে ছিল ২টি। আর ৩৬ বছরে অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে মাত্র ১২টি। ২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত মাত্র ২টি কূপ খনন করেছিল বিএনপি ও তত্বাবধায়ক সরকার।
পিএসএন/এমআই