চরম নিষ্ঠুরতার সাক্ষী হয়ে রইলো ভারতের পশ্চিমবঙ্গ।রাজ্যটির নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে বাস স্টাফরা নির্দয় আচরণ করেছেন এক মুসলিম নারী রোগীর প্রতি।
হাসপাতালে যাওয়ার পথে গুরুতর অসুস্থ জাহেরা বিবিকে (৪৫) রাস্তার মধ্যেই তার শিশু কন্যাসহ নামিয়ে দেয়া হয়। সেখানেই বিনা চিকিৎসায় মারা যান ওই নারী।
হাসপাতালের অনতিদূরে মায়ের মরদেহ আগলে বসে রইল বছর এগারোর বালিকা। টাকার অভাবে শববাহী গাড়ি মেলেনি। মায়ের মরদেহ নিয়ে রাস্তার ধারে ঘণ্টা দুয়েক বসে থাকার পর একটি পায় সে।
শুক্রবার (২১ মার্চ) হৃদয় বিদারক এ ঘটনাটি ঘটেছে নদিয়ার কৃষ্ণনগরে। কিডনির সমস্যা ছিল জাহেরা বিবির। ডাক্তার দেখাবেন বলে শুক্রবার সকাল ৯টা নাগাদ একটি বেসরকারি বাসে তেহট্ট থানা এলাকার তরণীপুর থেকে কৃষ্ণনগরের দিকে আসছিলেন তিনি। সঙ্গী নাবালক মেয়ে।
কিন্তু বাসের মধ্যে প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন জাহেরা। কৃষ্ণনগরে ঢোকার আগে ঘূর্ণি এলাকায় সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন তিনি। তখন ওই নারীযাত্রীকে কৃষ্ণনগর-করিমপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় নামিয়ে দেন বাসের কন্ডাক্টর। ছেড়ে যায় বাস।
বছরের এগারোর মেয়েটি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়া মাকে নিয়ে তখন অকূলপাথারে। কয়েকবার মাকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ করে সে।
কিন্তু বালিকার আকুতিতে কর্ণপাত করেননি কেউ। সময় গড়ায়। ওই ভাবে বাসস্ট্যান্ডের পাশে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অদূরে পড়েই থাকেন তিনি। ঢিল ছোড়া দূরত্বে স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে কেউ কেউ উঁকি মেরেছেন। ভিড় জমিয়েছিলেন পথচারীদের কেউ কেউ। কিন্তু কেউ সাহায্যের হাত বাড়াননি।
মায়ের অবস্থা দেখে কান্না বাড়ে মেয়ের। চিৎকার-আর্তনাদে জড়ো হন অনেকে। অবশেষে ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসেন দু’জন স্বাস্থ্যকর্মী। তারা খানিকক্ষণ পরীক্ষা করে নারীকে মৃত বলে ঘোষণা করে চলে যান। কিন্তু স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ দেখাননি কেউ।
অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া করে মায়ের দেহ নিয়ে যাওয়ার মতো টাকা ছিল না ছোট্ট মেয়েটির কাছে। অনেকে তাকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে জানানোর পরামর্শ দিয়ে নিজেদের কাজে চলে যান। অ্যাম্বুল্যান্স মেলেনি।
স্থানীয় এক জনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল মেয়েটি। তিনি ২ হাজার টাকা চান। ওই ভাবে আরও সময় গড়ায়। শেষমেশ কয়েকজন ব্যক্তির উদ্যোগে একটি ভ্যানের ব্যবস্থা হয়। তাতেই মায়ের মরদেহ চাপিয়ে বৃষ্টির মধ্যে ৪০ কিলোমিটার দূরে গ্রামের দিকে রওনা দেয় মেয়ে।
এই ঘটনায় কৃষ্ণনগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কর্তব্যরত চিকিৎসক বিশ্বনাথ বর্মণ বলেন, আমাদের কাছে এসে কেউ কিছু বলেননি। আমি কিছুই জানি না।
বাস থেকে এ ভাবে এক জন অসুস্থ, মুমূর্ষু রোগীকে নামিয়ে দেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে নদিয়া জেলা বাস মালিক সমিতির সম্পাদক তপন ঘোষ বলেন, চূড়ান্ত অমানবিক ঘটনা ঘটেছে। তবে কোন বাস থেকে এই ঘটনাটি ঘটেছে, আমরা খোঁজ নিচ্ছি। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, সে ব্যাপারে আমরা সচেষ্ট থাকব।
কৃষ্ণনগর শহর তৃণমূলের মুখপাত্র মলয় দত্ত বলেন, অভিযোগ যদি সত্যি হয়, তবে অত্যন্ত নিন্দনীয়। পৌরসভার টাকায় চিকিৎসকেরা মাইনে পান, কর্মীদের বেতন হয়। এত টাকা খরচ হচ্ছে। তার পরেও সাধারণ নাগরিকেরা ন্যূনতম পরিষেবা পাবেন না, এটা হতে পারে না।
কৃষ্ণনগর সাংগঠনিক জেলা বিজেপির মুখপাত্র সন্দীপ মজুমদার বলেন, চূড়ান্ত অমানবিক! রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে এর বিচার করা উচিত। পুলিশ, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসকেরা, পৌরসভার টহলরত কর্মীরা, কারো চোখে কেন পড়ল না এমন একটি দৃশ্য? দেখেও কেন সবাই এড়িয়ে গেলেন? এই প্রশ্নের জবাবদিহি করতে হবে।
কৃষ্ণনগর পৌরসভার চেয়ারম্যান রীতা দাস জানিয়েছেন, কী ঘটেছে তিনি জানেন না। খোঁজ নিয়ে দেখছেন।