খুলনা অঞ্চলের এবড়োখেবড়ো সড়কের কথা উঠলেই প্রথমে আসে মোজাহার এন্টারপ্রাইজ ও মাহাবুব ব্রাদার্সের নাম। যেখানে গণপূর্ত বিভাগের প্রকল্প, সেখানেই ছিলেন ঠিকাদার দাউদ হায়দার। পাশাপাশি কাজ পেয়েছেন জসিম উদ্দিন, আলিম আল রাজি আদিল ও শফিকুল ইসলাম মধু।
খুলনার ঠিকাদারি ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রসঙ্গ উঠলেই ঘুরেফিরে এই ক’জন ঠিকাদারের নাম চলে আসে। তাদের দোর্দণ্ড প্রতাপে অসহায় ছিলেন বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তারা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচাতো ভাইদের ছত্রছায়ায় গত সাড়ে ১৫ বছরে খুলনার সরকারি সংস্থার ৭০ শতাংশ কাজই করেছেন তারা। টাকার অঙ্কে যা প্রায় ১০ হাজার কোটিরও বেশি। এর মধ্যে দাউদ হায়দার মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য। মধু জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি। অন্যরা রাজনীতিতে জড়িত নন।
সাধারণ ঠিকাদারদের অভিযোগ, খুলনা অঞ্চলের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করতেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ সোহেল। তাঁকে মোটা অঙ্কের কমিশন দিয়ে কাজ কিনে নিতে হতো। দাউদ হায়দার, শেখ মাহবুবুর রহমান, কাজী মোজাহারুল হক, জসিম, আদিল, মধুসহ অন্য ঠিকাদাররা কমিশন দেওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে ছিলেন। এজন্য তারা প্রতি কাজের প্রাক্কলিত দরের ৫ থেকে ৮ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন দিতেন। বিনিময়ে অন্য ঠিকাদারদের দরপত্র জমা দিতে নিষেধ করা হতো। নির্দেশ না মানলে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণপূর্ত বিভাগের এক ঠিকাদার বলেন, নিষেধ না মেনে ডায়াবেটিক হাসপাতালের দরপত্র জমা দিয়েছিলাম। ওই রাতেই পুলিশ পাঠিয়ে আমার বাড়ি তছনছ করা হয়। পরে আবেদন করে দরপত্র প্রত্যাহার করে নিই।
ঠিকাদাররা জানান, ৫ থেকে ৮ শতাংশ কমিশন দিলেও কাজে লোকসান হতো না। কারণ উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় ঠিকাদারকে ৫ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিতে হয়। তবে কমিশন দিয়ে কাজ কিনলে তখন ঠিকাদাররা সেই ছাড় দিতেন না। সরকারের সাশ্রয় হওয়া টাকাটাই যেত আওয়ামী লীগ নেতাদের পকেটে।
প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে বারবার। ধীরগতির কাজ নিয়ে বছরের পর বছর ভুগেছে মানুষ। কিন্তু কোনো কিছুর বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি দপ্তরগুলোকে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কয়েকজন ঠিকাদারের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। মাহাবুব ছাড়া অন্যরা আত্মগোপনে চলে গেছেন। কয়েকটি প্রকল্পের কার্যাদেশ বাতিলেরও প্রক্রিয়া চলছে।
মোজাহারে বেহাল সড়ক
খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়ক থেকে তালা-বেতগ্রাম-পাইকগাছা জেলা সড়ক; খুলনায় খানাখন্দ ভরা সড়কের বেশির ভাগ কাজ করেছে মোজাহার এন্টারপ্রাইজ। গত সাড়ে ১৫ বছরে সড়ক বিভাগের একচেটিয়া ঠিকাদারি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। নিম্নমানের কাজ এবং সড়ক দ্রুত নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সমালোচনার মুখে শেষ দিকে নিজেদের গুটিয়ে নিতে থাকে প্রতিষ্ঠানটি।
সড়ক বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেক আগে থেকেই খুলনায় ঠিকাদারি করছে মোজাহার এন্টারপ্রাইজ। ২০১০ সালের পর তাদের কাজে নতুন গতি পায়। সড়ক বিভাগের বড় বড় ঠিকাদারি কাজ চলে যায় তাদের কবজায়। এক পর্যায়ে খুলনার গণ্ডি পেরিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে কাজ পেতে থাকেন তারা।
সড়ক বিভাগের হিসাবে গত সাড়ে ১৫ বছরে ১ হাজার ৩০৯টি কাজ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। টাকার অঙ্কে কাজের মূল্য ৬ হাজার ৫৩১ কোটি। খুলনা সিটি করপোরেশনসহ (কেসিসি) অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও কাজ করেছেন মোজাহার। তবে এর মধ্যে অনেক কাজ মোজাহারের লাইসেন্স ব্যবহার করে অন্য আওয়ামী লীগ নেতারা করেছেন।
সূত্র জানায়, মোজাহারের বেশির ভাগ কাজের মান নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে। তবু একের পর এক কাজ পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বিশেষ করে ২৬৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের দুই অংশ উদ্বোধনের আগেই চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। পরে বিপুল টাকা খরচ করে সেটি সংস্কার করে সড়ক বিভাগ। যশোর-বেনাপোল মহাসড়কের কাজও করেছিল মোজাহার এন্টারপ্রাইজ। ৩২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণের পরও টেকেনি সেই সড়ক।
পুরোনো কাজ নিয়ে এখনও ভোগাচ্ছে মোজাহার এন্টারপ্রাইজ। বর্তমানে ৩৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে তালা-বেতগ্রাম-কয়রা সড়ক উন্নয়নের কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রায় ৪ বছরেও ৬৫ কিলোমিটার সড়কের কাজ শেষ করতে পারেনি তারা। দুর্ভোগ যেন ওই এলাকার মানুষের নিত্যসঙ্গী। গত ৫ আগস্টের পর মালপত্র নিয়ে তারা চলে গেছে। এ ছাড়া সাতক্ষীরায় বেত্রাবতী নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণের কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। সেটির কাজেও গতি নেই।
দেশের বাইরে থাকায় কাজী মোজাহারুল হকের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলতে পারেনি সমকাল। তবে সড়ক বিভাগ খুলনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আনিসুজ্জামান মাসুদ বলেন, আগের প্রকল্পগুলোর তথ্য আমার কাছে নেই। তবে সঠিক সময়ে কাজ না করায় তালা-বেতগ্রাম সড়কের কার্যাদেশ বাতিল করা হচ্ছে।
সব দপ্তরে সমান আধিপত্য মাহাবুব ব্রাদার্সের
অন্য ঠিকাদাররা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক হলেও ব্যতিক্রম শুধু মাহাবুব ব্রাদার্স। গত সাড়ে ১৫ বছরে সড়ক বিভাগ, গণপূর্ত, কেডিএ, কেসিসি, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে সমানতালে কাজ করেছে মাহাবুব ব্রাদার্স। দপ্তরগুলোতে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার কাজ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এখনও বিভিন্ন দপ্তরে তাদের প্রায় ৪৬১ কোটি টাকার কাজ চলছে। কোনোটিই সময়মতো শেষ করতে পারছে না তারা।
মাহাবুব ব্রাদার্সের মালিক শেখ মাহবুবুর রহমান খুলনার সাবেক মেয়র তালুকদার আবদুল খালেকের ঘনিষ্ঠ। তাঁর বাবা কেসিসির সাবেক কাউন্সিলর শেখ মজনু ছিলেন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী। বাবার মৃত্যুর পর ব্যবসার হাল ধরেন মাহাবুব। তবে বাবার ব্যবসা না বাড়িয়ে ডুবিয়েছেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, অতিরিক্ত কমিশন দিয়ে কাজ নেওয়া, শেখ বাড়ির সঙ্গে অতি ঘনিষ্ঠতা ও এমপিদের নির্বাচনী খরচ বহনের চাপ এবং একসঙ্গে সব দপ্তরে কাজ চলায় কোনোটি শেষ করতে পারেননি।
সড়ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ১৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে যশোর-খুলনা মহাসড়কের একাংশের কাজ করেছিল মাহাবুব ব্রাদার্স। এক বছরও টেকেনি সেই কাজ। এই বছরের শুরুতে খুলনার শেরেবাংলা সড়ক চার লেন এবং জিরো পয়েন্ট মোড় উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের কাজ শেষ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ১২৭ কোটি টাকার এই কাজ নিয়ে চার বছর ভুগেছে মানুষ।
বর্তমানে ১৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে কেডিএর শিপইয়ার্ড সড়ক চার লেন, ৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে কেসিসির আধুনিক বর্জ্য পরিশোধন কেন্দ্র এবং কুয়েট অ্যাপ্রোচ রোড, ৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ভবন, ৯৬ কোটি টাকা ব্যয়ে কেডিএর বিপণিবিতান এবং প্রায় ৫০ কোটি টাকা খরচায় কয়রা-কাশিরহাটখোলা-নোয়াবেকি সড়কের কাজ করছে মাহাবুব ব্রাদার্স। এ ছাড়া অন্যের লাইসেন্সে খুলনা জেনারেল হাসপাতালের ভবন নির্মাণে ৩২ কোটি টাকার কাজও করছে তারা। এর একটি কাজেও গতি নেই। কেসিসির প্রধান প্রকৌশলী মশিউজ্জামান খান বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ না করলে তাদের কালো তালিকাভুক্ত করা হবে। কেডিএর শিপইয়ার্ড সড়কের প্রকল্প পরিচালক আরমান হোসেন বলেন, দীর্ঘদিন কাজ ফেলে রাখায় জট তৈরি হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মাহবুবুর রহমান বলেন, প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে কাজ পেয়েছি। প্রতিটি কাজের সাইটে বাস্তব কিছু সমস্যা রয়েছে। এ কারণে কাজে সময় লেগেছে। এখন সব কাজ সমান গতিতে চলছে।
গণপূর্ত মানেই দাউদ হায়দার
গত সাড়ে ১৫ বছর খুলনা গণপূর্ত বিভাগ আর এসএন বিল্ডার্স যেন ছিল একই বৃন্তের দুই ফুল। সরকারি বড় কোনো প্রকল্প এলেই শেখ দাউদ হায়দারের মালিকানাধীন এসএন বিল্ডার্সকে কাজ দেওয়া নিয়মে পরিণত হয়। আওয়ামী লীগ আমলে খুলনা গণপূর্তের শতাধিক কাজ পেয়েছে তাঁর প্রতিষ্ঠান। এর বাইরে ঠিকাদার জসিম, মধু ও আদিল গণপূর্ত বিভাগে প্রায় হাজার কোটি টাকার কাজ করেছেন।
এর মধ্যে ২০২২ সালে অসুস্থ হওয়ার পর ঠিকাদার জসিম উদ্দিন ব্যবসা গুটিয়ে নেন। এর আগে বিএসটিআই ভবন, সমাজসেবা কমপ্লেক্স, পুলিশ সুপার কার্যালয়সহ বড় কাজগুলো তিনিই করতেন।
খুলনা গণপূর্ত বিভাগ-২-এর আওতায় ২৮৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন জেলা কারাগার নির্মাণ করা হচ্ছে। ৩৮টি প্যাকেজের আওতায় বাস্তবায়ন হচ্ছে প্রকল্পটি। এর মধ্যে ৫৮ কোটি টাকার ১০টি প্যাকেজের কাজ করেছেন দাউদ হায়দার। সাতটি প্যাকেজ করেছেন আদিল, পাঁচটি করেছেন ঠিকাদার মধু। এভাবে বড় প্রকল্পের ঠিকাদারি কাজগুলো কয়েকজনের মধ্যে ভাগ করা হতো।
বর্তমানে ৮২ কোটি টাকা ব্যয়ে ক্যান্সার হাসপাতালের কাজ করছেন দাউদ হায়দার। তবে কাজের গতিতে ভাটার টান। মধুর চারটি কাজের একটিও শেষ হচ্ছে না। তাদের নিয়ে বিপাকে পড়েছেন প্রকৌশলীরা।
সূত্র জানায়, ৫ আগস্টের পর দাউদ হায়দারের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা হয়েছে। অন্যরা ভয়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন। তাদের মোবাইল ফোন নম্বরও বন্ধ।
গণপূর্ত বিভাগ-২-এর সদ্য বিদায়ী নির্বাহী প্রকৌশলী রাজিবুল ইসলাম বলেন, ইজিপির দরপত্র নিয়ন্ত্রণের সুযোগ নেই। বাইরে কিছু হয়ে থাকলে আমার জানা নেই। কিছু প্রকল্পের কাজে ধীরগতি ছিল, সেগুলো দ্রুত শেষ করার চেষ্টা চলছে।