ক্রিপ্টোকারেন্সির জটিল পথঘাট নিয়ে আলোচনাটা অনেকের জন্যই কঠিন একটা বিষয়। তবে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কাছে বিষয়টা যেন খুব সহজ। তিনি বলেছিলেন- ক্রিপ্টোকারেন্সি মাইনিংয়ের ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই কিছু সুবিধা আছে। চলতি সপ্তাহে রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর রুশ প্রেসিডেন্ট এখন ওইসব সুবিধাগুলোর দিকে নতুন করে চোখ দিতে পারেন।
জানুয়ারিতে পুতিন যখন তার দেশে ক্রিপ্টেকারেন্সির সুবিধা নিয়ে কথা বলছিলেন তার কয়েকদিন আগেই তার দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্রিপ্টোকারেন্সির ট্রেডিং ও মাইনিং নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব দিয়েছিল। ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত বিটকয়েনের ক্ষেত্রে মাইনিং বলতে এমন একটি পদ্ধতি বোঝায় যেখানে কোনো কাজের মাধ্যমে নতুন বিটকয়েনের লেনদেন সনাক্ত করা হয়। এরপর সেই বিটকয়েন ব্লকচেইন নামে পরিচিত একটি ভার্চুয়াল লেজারে রাখা হয় এবং ওই কাজের স্বীকৃতি দিয়ে নতুন বিটকয়েন তৈরি হয়।
দ্য ব্যাংক অব রাশিয়া তাদের সতর্কবার্তায় জোর দিয়ে বলেছিল ক্রিপ্টোকারেন্সি মাইনিং দেশের অর্থনীতি এবং আর্থিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় রকমের ঝুঁকির কারণ হতে পারে। এর এক সপ্তাহ পরই পুতিন দৃশ্যপটে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিলেন জ্বালানি খাতে রাশিয়ার ব্যাপক সম্পদ ও দক্ষতার জন্য ক্রিপ্টোকারেন্সি মাইনিংয়ে তাদের জন্য বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে।
এদিকে এরই মধ্যে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরু করলে দেশটিকে চাপে ফেলতে তার অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে পশ্চিমারা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং কানাডা রাশিয়ার বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভকে লক্ষ্য করেছে। এই রিজার্ভ জরুরি কোনো পরিস্থিতি বা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনার সময় ব্যবহারের উদ্দেশ্য নিয়ে রাখা আছে। মূলত রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গচ্ছিত তাদের ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভ যেন কোনোভাবে নিষেধাজ্ঞার সামনে টিকতে না পারে সে উদ্দেশ্য নিয়ে এমন পথে এগিয়েছে পশ্চিমা জোট।
এদিকে এক দেশ থেকে অন্য দেশে তহবিল স্থানান্তরে ব্যাংকগুলো যে বার্তা ব্যবস্থা ব্যবহার করে সেই সুইফট যেন রাশিয়ার ব্যাংকগুলো ব্যবহার করতে না পারে সে ব্যবস্থাও নিয়েছে এই জোট।
এখন এই পরিস্থিতিতে রাশিয়া এবং দেশটির ব্যাংকগুলো ক্রিপ্টোকারেন্সির দিকে নজর দেবে কারণ সেটাই ডলারের ইন্টারন্যাশনাল এক্সচেঞ্জের একটা বিকল্প হতে পারে। আবার ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলো ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংকিং সিস্টেমকে পাশ কাটাতেও সক্ষম। আর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের ক্ষেত্রে এই ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংকিং সিস্টেমটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা পর্ব।
ব্লকচেইন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ, অফ দ্য চেইনের প্রতিষ্ঠাতা এরিক মিশাউদ এ বিষয়ে বলছেন, আমরা এখন এমন এক ঐতিহাসিক সময়ে আছি যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো যেখানে একসময় বৈশ্বিক নীতি নির্ধারণ করত, এখন সেখানে তাদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ নেই। আর ক্রিপ্টোকারেন্সির মতো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণহীন একটি ব্যবস্থায় রাশিয়ার মতো বড় অর্থনীতিকে নজরদারি করার ব্যবস্থা নেই।
অন্য ক্রিপ্টো বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্লকচেইনগুলোর কর্মপ্রক্রিয়া খুবই স্বচ্ছ। তাই নিষেধাজ্ঞা আরোপিত কোনো দেশ চাইলেই ওই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করতে পারবে না।
তারপরও নিষেধাজ্ঞা ফাঁক বের করে ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহারে সফল হয়েছে কিছু দেশ। জ্বালানিসমৃদ্ধ ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বড় ধরনের অথনৈতিক নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তারা ইরানভিত্তিক বিটকয়েন মাইনারদের ব্যবহার করে বিটকয়েনগুলো নগদে রুপান্তর করতে সক্ষম হচ্ছে। তারপর সেই অর্থ দিয়ে তারা প্রয়োজনীয় আমদানি করতে পারছে।
এলিপটিক নামে একটি ব্লকচেইন কনসালটেন্সি বলছে, বাণিজ্য অবরোধ পাশ কাটিয়ে বিটকয়েন মাইন করে ইরান বিশ্ববাজারে তাদের পণ্য বিক্রি করছে।
এই প্রতিষ্ঠানের পলিসি এবং রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক ডেভিড কারলাইল বলছেন, ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজের তথ্য অনুযায়ী বিটকয়েন মাইনিংয়ে তৃতীয় বৃহত্তম দেশ হলো রাশিয়া। আর এ পরিস্থিতি সেটাই হবে তাদের জন্য সবচেয়ে কার্যকর একটা পথ।
তিনি আরও বলেন, বিদ্যমান ক্রিপ্টো যা দিয়ে বিভিন্ন দেশের সরকারের সঙ্গে বাণিজ্য করা যাবে, সেটা ছাড়াও এ সংক্রান্ত অর্থনৈতিক কার্যকলাপে করারোপ করতে পারে রাশিয়া। তার এর লাইসেন্স দিতে পারে ও এর ওপর কর আরোপ করতে পারে।
এলিপটিকের হিসেবে, বিটকয়েন মাইনিং করে ইরান প্রতিবছর প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মতো আয় করে থাকে।
কারলাইল বলেন, রাশিয়ার হাতে একবার বিপুল পরিমাণ বিটকয়েন চলে এলে দেশটি তা দিয়ে তাদের বিভিন্ন আমদানি পণ্যের মূল্য পরিশোধ করতে পারবে। মার্কিন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার কারণে স্বাভাবিক পথে ওই লেনদেন সম্ভব হতো না।
তবে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল গত সপ্তাহে একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে রাশিয়ার ক্রিপ্টোকারেন্সি মার্কেটের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথাও ভাবছে যুক্তরাষ্ট্র। এলিপটিকের মতো কোম্পানির হাতে এমন সফটওয়্যার আছে যা দিয়ে তারা অবৈধ ক্রিপ্টো লেনদেন চিহ্নিত করতে পারে।
ব্লকচেইন অ্যানালাইসিস ফার্ম চেইনালাইসিস বলছে, ব্লকচেইনগুলোর স্বচ্ছ প্রকৃতির কারণে নিষেধাজ্ঞা ফাঁকি দেওয়াটা কঠিন হবে। এ ধরনের লেনদেনগুলো ব্লকচেইন লেজারে ধরা পড়ে যায়।
কী এই বিটকয়েন?
প্রচলিত মুদ্রাব্যবস্থায় যেমন একটি দেশের সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক জড়িত থাকে, বিটকয়েনের ক্ষেত্রে তা হয় না। ইলেকট্রনিক মাধ্যমে অনলাইনে দুজন ব্যবহারকারীর মধ্যে সরাসরি (পিয়ার-টু-পিয়ার) আদান-প্রদান হয়। লেনদেনের নিরাপত্তার জন্য ব্যবহার করা হয় ক্রিপ্টোগ্রাফি নামের পদ্ধতি। নিজের পরিচয় প্রকাশ না করেই এতে লেনদেন করা যায়। অন্যদিকে লেনদেনের ব্যয় খুব কম। অনলাইনে ডলার-পাউন্ড-ইউরোর পাশাপাশি কেনাকাটা করা গেলেও অনেক দেশই বিটকয়েনকে মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। বিটকয়েনের মতো ক্রিপ্টোকারেন্সগুলো থেকে ভার্চ্যুয়াল মুদ্রানির্ভর ভবিষ্যৎ আর্থিক ব্যবস্থার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
এটা ছাড়া রাশিয়া ক্রিপ্টোকারেন্সি হ্যাকিংয়ের পথে যেতে পারে; যে পথে ইতোমধ্যে হেঁটেছে উত্তর কোরিয়া। চেইনালাইসিস বলছে, ক্রিপ্টোকারেন্সি প্লাটফর্ম হ্যাক করে কিম জং উনের দেশ উত্তর কোরিয়া ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আত্মসাত করেছে।
এছাড়া র্যানসমওয়ের অ্যাটাকও হয় নিয়মিত; যার মাধ্যমে একটি কম্পিউটারের নিয়ন্ত্রণ নেয় অপরাধীরা। আর সেই কম্পিউটারকে আগের দশায় ফিরিয়ে দিতে তারা ক্রিপ্টোকারেন্সি চায়। এ ধরনের কাজে সহযোগিতার অপরাধে গতবছর দুটি রুশ ক্রিপ্টোকারেন্সি এক্সচেঞ্জকে নিষিদ্ধ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জ বাইন্যান্স বলছে, নিষেধাজ্ঞার আওতাভুক্ত রুশ নাগরিকদের অ্যাকাউন্ট ব্লক করছে তারা।
এলিপটিকের কারলাইলের মতে, রাশিয়া কোনোভাবে তাদের ক্রিপ্টো মালিকানার বিষয়টি হয়তো গোপন রাখার চেষ্টা করবে। রুশ সরকার বা রুশ কোনো প্রতিষ্ঠান যদি নিষেধাজ্ঞা পাশ কাটাতে চায় তবে তাদের এক্সচেঞ্জ সার্ভিসের একটা নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হবে। এছাড়া এমন কিছু ক্রিপ্টোকারেন্সি আছে যেগুলোর লেনদেন চিহ্নিত করা কঠিন। যেমন : মনেরো।
কিন্তু সবকিছুর পরও কারলাইল মনে করেন যে বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মুখে রাশিয়া রয়েছে তা পূরণে ক্রিপ্টোকারেন্সি যথেষ্ট নয়। নিষেধাজ্ঞার পুরো প্রভাব কাটাতে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন রাশিয়ার পড়বে ক্রিপ্টোকারেন্সি তার জন্য যথেষ্ট নয়। রাশিয়ার পুরো ব্যাংকিং খাতের সম্পদ মূল্য ১.৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার; যা প্রায় পুরো ক্রিপ্টো মার্কেটের সমান।
ক্রিপ্টোকারেন্সির বিকল্প পথও রয়েছে। সুইফট নেটওয়ার্ক থেকে রাশিয়াকে বের করে দেওয়ার ফলে চীন তাদের তৈরি ক্রস-বর্ডার ইন্টারন্যাশনাল পেমেন্ট সিস্টেম আরও শক্তিশালী করার দিকে নজর দেবে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান র্যান্ড ইউরোপের সিনিয়র অ্যানালিস্ট আলেক্সি ড্রিউ বলছেন, এটা অবিশ্বাস্য না যে, রাশিয়ার ওপর আরোপিত এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে চীন রাশিয়াকে তাদের পেমেন্ট সিস্টেমে নিয়ে যাবে।
অথবা আরও সহজ একটা সমাধান হয়তো রাশিয়ার হাতে আছে। রাশিয়া ইতোমধ্যে তার নিজের ডিজিটাল রুবল তৈরির কাজ করছে।