ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ইসলামি দলগুলোকে নিজেদের সঙ্গে রাখতে চায় দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তার সাবেক জোটসঙ্গী বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এ নিয়ে দল দুটির মধ্যে এক ধরনের রশি টানাটানি শুরু হয়েছে।
ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিমের সঙ্গে এক সপ্তাহের ব্যবধানে সাক্ষাৎ করেছেন জামায়াতে ইসলামির আমির শফিকুর রহমান ও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তাদের সাক্ষাতের পর বিষয়টি রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা তৈরি করেছে।
গত সোমবার চরমোনাই পীরের সঙ্গে বিএনপি মহাসচিবের বৈঠকের পর দশ দফার একটি সমঝোতার কথা ঘোষণা করা হলেও জামায়াত বলছে তারা গত আগস্টে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে জোট করার জন্য আলোচনার যে প্রক্রিয়া শুরু করেছে তা এখনো চলমান আছে।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ অবশ্য সোমবারের বৈঠককে ‘রাজনৈতিক শিষ্টাচার’ ও দশ দফাকে ‘স্বাভাবিক রাজনৈতিক ঐক্যমত’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।’
বিএনপি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতিতে বিশ্বাস করে বলেই আমরা সবার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা কিংবা আলোচনা করে থাকি।’-বলেন তিনি।
দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলছেন ‘জামায়াত হঠাৎ করেই বিভিন্ন দলকে নিজেদের পক্ষে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করছে কারণ তারা জানে অন্যের সহায়তা ছাড়া তারা নির্বাচনে কখনো সুফল পায়নি।’
জামায়াতের মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ অবশ্য বলছেন ‘ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে আগস্ট থেকে আমাদের আলোচনা চলছে এবং সে প্রক্রিয়া চলমান আছে’।
রাজনৈতিক দলগুলোর এসব বৈঠক ভোটকে সামনে রেখে জোটকে শক্তিশালী করা কিংবা ধর্মকে ব্যবহারের যে চর্চা দীর্ঘকাল বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে হয়ে আসছে তারই অংশ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকদের অনেকে।
‘এখন বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে যে রশি-টানাটানি দেখা যাচ্ছে এটি আসলে সেই চর্চারই প্রাথমিক প্রস্তুতি।’-বলছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোবায়দা নাসরিন।
গত বছর আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার ছয় মাস পার করলেও নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ এখনো ঘোষণা হয়নি। ড. ইউনূস অবশ্য আগেই জানিয়েছেন যে চলতি বছরের শেষে বা আগামী বছরের শুরুটা নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমা হতে পারে।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নির্বাচনের সময়সীমা ইস্যুতেই দূরত্ব তৈরি হয়েছিল এক সময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র বিএনপি ও জামায়াতের। বিএনপি চাইছিল সংস্কারের পাশাপাশি দ্রুত নির্বাচন আর জামায়াত নির্বাচনের আগে সংস্কারকে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছিল।
এর জের ধরে দু দলের নেতারা পরস্পরকে ইঙ্গিত করে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিতে শুরু করেন। গত ২৭শে ডিসেম্বর দলটির কর্মী সম্মেলনে ‘একজন চাঁদাবাজ পালিয়েছে, আরেকজন চাঁদাবাজিতে লেগে গেছে’ বলে মন্তব্য করেছিলেন জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান।
অন্যদিকে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের কেউ কেউ একাত্তরে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। দলটির একজন নেতা ৫ আগস্টের পর ইসলামী ব্যাংক দখলের জন্যও জামায়াতকে ইঙ্গিত করে নানা মন্তব্য করেন।
এর মধ্যেই জামায়াতে ইসলামি অন্য ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে নিয়ে জোট গড়ার উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা শুরু করে। পাশাপাশি বিএনপিও ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দলের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ চলমান রাখে।
এর মধ্যেই গত ২১ জানুয়ারি জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান বরিশালের চরমোনাইয়ে গিয়ে ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে সেই খবর রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেকের দৃষ্টিতে আসে।
কিন্তু এর এক সপ্তাহের মধ্যেই সোমবাররেজাউল করিমের সঙ্গে ঢাকায় তার কার্যালয়ে গিয়ে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ওই বৈঠকের পর দশটি বিষয়ে দুই দল একমত হয়েছে বলে জানান দুই নেতা।
যদিও জামায়াতের আমিরের সঙ্গে বৈঠকের পর চরমোনাই পীর সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম বলেছিলেন যে ‘জামায়াতে ইসলামী ছাড়াও অনেকগুলো ইসলামভিত্তিক দলের সঙ্গেই তারা এখন আলোচনা করছেন, কারণ তারা চান তাদের ভোট এক বাক্সেই থাকুক’।
কিন্তু এর পরপরই বিএনপির সঙ্গে তার বৈঠকের খবর এলে অনেকেই এটিকে নির্বাচনী কৌশল কিংবা প্রস্তুতির অংশ হিসেবে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যকার ‘রশি টানাটানি’ হিসেবে মন্তব্য করছেন।
এর মধ্যে ২২শে জানুয়ারি খেলাফত মজলিসের আমিরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপির মহাসচিব ও স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।
শেখ হাসিনার সরকার বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিল এমন ছোট বড় ধর্মভিত্তিক অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও বিএনপি যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে বলে দলের নেতারা ইঙ্গিত দিয়েছেন।
‘বিএনপি যে সংস্কার কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল তখনই বিএনপি অঙ্গীকার করেছে যে বিএনপি নির্বাচনের মাধ্যমে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় গেলেও যারা আন্দোলনে ছিল তাদের সবাইকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে। কিন্তু জামায়াত তো হুট করে ৫ আগস্টের পর থেকে চেষ্টা তদবির শুরু করেছে।’-বলেন সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল।
ওদিকে খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ও নেজামে ইসলামসহ কয়েকটি দল ছাড়াও ইসলামপন্থী দল হিসেবে পরিচিত ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ওপর প্রভাব আছে এমন কয়েকজন ব্যক্তিত্বের সঙ্গেও ধারাবাহিক বৈঠক করে আসছে জামায়াতে ইসলামী।
দলটির নেতারা বরাবরই ইঙ্গিত দিয়ে আসছিলেন যে একটি সম্ভাব্য নির্বাচনি জোট গড়তেই তাদের এ তৎপরতা চলছে।
‘আমরা মনে করি প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। তাই নির্বাচনকে সামনে রেখে যারা যেভাবেই চেষ্টা করুক তাকে আমরা খারাপ ভাবে দেখি না। হয়তো আমাদের আমিরের পরপরই বিএনপি মহাসচিব ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে আলোচনা করায় আলোচনাটা বেশি হচ্ছে।-বলেন জামায়াতের মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ।
তিনি বলেন ‘ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে জামায়াতের আলোচনা অব্যাহত আছে এবং এ নিয়ে জামায়াত একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় আছে। তবে তাই বলে দলগুলোর সঙ্গে অন্য কেউ কথা বলতে বা কোন কোন বিষয়ে একমত হতে পারবে না-এমন কোন কথা নেই’।
বিএনপি ও জামায়াত ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে সঙ্গে রাখতে রশি টানাটানিতে জড়িয়ে পড়েছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, তার ধারণা ‘রশি টানাটানি’ হবে না। ‘বিভিন্ন পক্ষ আলোচনা করাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। নির্বাচন ও রাজনীতিতে এগুলো স্বাভাবিক। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সময় এলে জানা যাবে।’
বিশ্লেষকরা অনেকেই মনে করেন সামনে যখনি নির্বাচন হোক সেই নির্বাচনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ অনেকটাই অনিশ্চিত। সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম এর মধ্যেই বলেছেন যে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেয়া হবে না।
এমন পরিস্থিতিতে ইসলামপন্থী, অ্যান্টি আওয়ামী লীগ ও ভারত বিরোধী হিসেবে পরিচিতরাই ভোটের ময়দানে পরস্পরের প্রতিপক্ষ হবে। আবার আন্দোলনকারী ছাত্রদের দল গঠন হলে তারাও একই ভোট ব্যাংক দখলের চেষ্টা করবে।
ধারণা করা হচ্ছে যে এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি হয়তো চিন্তা করতে পারে যে ইসলামপন্থী বা ধর্মভিত্তিক সব দল যেন তাদের বিরুদ্ধে চলে না যায় কিংবা এসব দলগুলো এক হয়ে যেন বিএনপির বিরুদ্ধে নির্বাচনে না থাকে।
আবার বিএনপির অনেকে মনে করেন আন্দোলনকারী ছাত্ররা নির্বাচনে জোটবদ্ধ হওয়ার প্রশ্ন আসলে জামায়াতের দিকেই হেলে পড়তে পারে।
সবমিলিয়ে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মোর্চা হলে এবং ছাত্ররাও দল গঠন করলে – উভয় পক্ষই বিএনপির জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে। সে কারণেই বিএনপির নেতৃত্ব চাইছেন ইসলামপন্থীদের একাংশ অন্তত যেন নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গেই থাকে।
আওয়ামী লীগ শাসনামলের বড় অংশজুড়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে জামায়াতে ইসলামী ছাড়াও বেশ কয়েকটি ইসলামপন্থী দল সক্রিয় ছিল।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন বলছেন, ভোট এলেই ধর্ম আর জোটের গুরুত্ব বেড়ে যাওয়া বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে সবসময় দেখা যায় এবং এবারেও সেই তৎপরতাই শুরু হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
‘ধর্মভিত্তিক ছোট ছোট দলগুলোর হয়তো তেমন ভোট নেই কিন্তু তারা যখন বড় দলের সঙ্গে যুক্ত হয় তখন তার একটা গুরুত্ব তৈরি হয়। তাছাড়া জোট ভারী করার একটা প্রতিযোগিতাও সবসময় হয়ে আসছে। সেটাই এখন বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া বাংলাদেশে ভোটের রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহারের একটা চেষ্টা কিন্তু অনেক কাল ধরেই হয়ে আসছে।-বলেন তিনি। সূত্র: বিবিসি বাংলা।