কারা অধিদফতরের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি খুঁজতে তৎপর হয়ে উঠেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুর্নীতিতে জড়িত হয়েছেন এমন কর্মকর্তাদের তালিকা করে এর মধ্যে শুরু হয়েছে অনুসন্ধান কার্যক্রম। গত দুই দিনে কারা অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন ছয় কর্মকর্তাকে সেগুনবাগিচার দুদক কার্যালয়ে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর থেকে রীতিমতো তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে কারা অধিদফতরে। এর আগে গত মাসেও কারাগারের তিন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এখন পর্যন্ত কারাগারের ২৫ জন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আরও কয়েকজন কর্মকর্তাকে শিগগিরই ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের তথ্য পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে মামলা করা হবে। কারা সূত্র বলছে, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা কর্মচারীরা আতঙ্কের মধ্যে দিন পার করছেন। তারা অতীতের মতো সিন্ডিকেট তৈরি করে এ অনুসন্ধান বন্ধ করার জন্য নানাভাবে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। দুদক সচিব মাহাবুব হোসেন জানিয়েছেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে কারা কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। কোনো ব্যক্তিবিশেষের ওপর টার্গেট করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে না। যার বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যাবে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ও বিধি মোতাবেক তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করবে। দুর্নীতির বিষয় প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, প্রাথমিক অনুসন্ধানে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার পরই কারা কর্মকর্তাদের ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সারা দেশের কারাগারের প্রায় ৫০ কর্মকর্তার অভিযোগও দুদকের নজরদারিতে রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, দীর্ঘদিন ধরেই কারা অধিদফতর নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে আছে। কারা প্রশাসনের কেউ দুর্নীতি দমনে শক্ত ব্যবস্থা নিতে চাইলে অধিদফতরের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট নানাভাবে সেই কর্মকর্তাকে হেনস্তা করে। এ কারণে কারাগারের দুর্নীতি নিয়ে নানা আলোচনা হলেও তা দমনে কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। কিন্তু ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম থেকে ময়মনসিংহগামী বিজয় এক্সপ্রেস থেকে কারা কর্মকর্তা সোহেল রানা বিশ্বাসকে নগদ ৪৪ লাখ টাকা ও কয়েক কোটি টাকার চেকসহ রেলওয়ে পুলিশ আটকের পর বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। আটকের পর সোহেল রানা জানান, অবৈধভাবে উপার্জিত এসব অর্থ তিনি বিভিন্ন কর্মকর্তাকে দেওয়ার জন্য নিয়েছিলেন। পরে বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন। প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে গত নভেম্বরে চট্টগ্রামের সাবেক জেলার সোহেল রানার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে একটি মামলা করা হয়। একই সঙ্গে কারাগারের যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।দুদক সূত্র জানান, সোহেল রানা বিশ্বাসের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই কারা অধিফতরের সাবেক ডিআইজি পার্থ গোপাল বণিকের বাসায় ২০১৯ সালের ২৯ জুলাই অভিযান চালিয়ে নগদ ৮০ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় দুদকের সহকারী পরিচালক সালাউদ্দিন বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় আদালতে চার্জশিট দেওয়ার পর বিচার শেষে চলতি বছরের জানুয়ারি পার্থ গোপাল বণিককে দুটি ধারায় আট বছরের কারাদ দিয়েছে আদালত। এরই ধারাবাহিকতায় ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সাবেক ও বর্তমানে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার ইকবাল কবীর চৌধুরী, সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের সাবেক জেল সুপার ও বর্তমানে কাশিমপুর কারাগারে দায়িত্বরত আবদুল জলিল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ কারাগারের জেলার হাবিবুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। দুদকের সহকারী পরিচালক মো. সাইদুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি টিম তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। এ ছাড়া গত রোববার খুলনা বিভাগীয় কারা কর্মকর্তা (ডিআইজি প্রিজন) সগীর মিয়া, কাশিমপুর কারাগারের জেল সুপার গিয়াস উদ্দিন মোল্লা ও মেহেরপুর জেলা কারাগারের জেল সুপার মোখলেসুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। গতকাল জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় কারা অধিদফতরের এআইজি প্রিজন মাইনুদ্দিন ভূঁইয়া ও মৌলভীবাজার কারাগারের জেলার আবু মুসাকে।
দুদক সূত্র জানান, কারাগারে সিট-বাণিজ্য, বন্দি-বাণিজ্য, খাবারের অনিয়ম, মাদক কারবার, টাকার বিনিময়ে বন্দিদের বিশেষ সুবিধা, মোবাইল ফোন ব্যবহারসহ বিশেষ ব্যবস্থায় নারীসঙ্গের ব্যবস্থা করে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। এ ছাড়া কারাগারের ভিতরে টাকার বিনিময়ে কারা হাসপাতালে থাকার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। কারা অধিদফতরের নিয়োগ ও বিভিন্ন কেনাকাটায় ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া টাকা ছাড়া বন্দিদের সঙ্গে স্বজন ও আইনজীবীদের সাক্ষাৎ মেলে না। কেউ মামলা থেকে জামিন পেলে সেই প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করা এবং আরেক মামলায় গ্রেফতার দেখানোর ভয় দেখিয়েও অর্থ আদায় করা হয়। তবে দুদকের সাম্প্রতিক উদ্যোগকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য, বিশেষ করে সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিস যেন দুদক না দেয় সে জন্য নানাভাবে তদবির চলছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানান, কারাগারের উন্নয়নের নামে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। এর আগে কারারক্ষী নিয়োগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুসন্ধানেও ব্যাপক অনিয়মের তথ্য উঠে আসে। এক জেলার প্রার্থী হয়ে অন্য জেলা কোটায় নিয়োগের বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ার পরও প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের কারণে কারও বিরুদ্ধে বিভাগীয় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বিশেষ করে সৎ কর্মকর্তারা এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করলেই তাদের সরিয়ে দেওয়ার তৎপরতা শুরু করে ওই সিন্ডিকেট। এর আগে একজন কারা মহাপরিদর্শককে দ্রুত সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টায়ও সফল হয় তারা। কারাগারের সাবেক ডিআইজি প্রিজন মেজর (অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী বলেন, কারা অধিদফতরের দুর্নীতি কমাতে মন্ত্রণালয় ও জেল কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে উদ্যোগ নেওয়া উচিত। দুদকের একার পক্ষে আইন করে দুর্নীতি কমানো সম্ভব নয়। তাদের জন্য মোটিভেশনাল উদ্যোগ নেওয়া দরকার। এ বিষয়ে প্রত্যাশা থাকবে, দুদকের যে কর্মকর্তা জিজ্ঞাসাবাদ করবেন তার গুণাবলি দেখে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা যেন লজ্জিত হন এ বিষয়টি নিশ্চিত করা উচিত।
পিএসএন/এমঅাই