গত বছরের চেয়ে এবার হজের খরচ বেড়েছে প্রায় দুই লাখ টাকা। ফলে নয় দফা সময় বাড়ানোর পরও নির্ধারিত কোটা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। ফাঁকা প্রায় পাঁচ হাজার কোটা ফেরত যাচ্ছে।
আগামীতে হজের খরচ আরও বাড়বে— এমন আভাসও দিয়েছে মন্ত্রণালয়। সবমিলিয়ে সামনের বছরগুলোতে নির্ধারিত কোটার হজযাত্রী পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এমন শঙ্কার মধ্যেও একটু স্বস্তির পরশ নিয়ে এসেছে ‘আজিজিয়া’ নামের নতুন একটি হজ প্যাকেজ। এ প্যাকেজের মাধ্যমে কম খরচে হজ করা যাবে।
চলতি প্যাকেজ থেকে নতুন এ প্যাকেজের খরচ এক থেকে দেড় লাখ টাকা কম পড়বে। আপাতত সরকারি ব্যবস্থাপনায় শুরু হলেও পরে বেসরকারিতে এ প্যাকেজ চালুর চিন্তা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে। এছাড়া সমুদ্রপথে হজে যেতে কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেড নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবও রয়েছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা জানান, মক্কার হেরেম শরিফ থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে আজিজিয়া নামক স্থানের সঙ্গে মিল রেখে এ প্যাকেজের নাম ‘আজিজিয়া’ রাখা হচ্ছে। ২০২০ সালে প্রয়াত তৎকালীন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শেখ মো. আবদুল্লাহ এ প্যাকেজ চালুর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু করোনার কারণে তা আটকে যায়। দুই বছর বন্ধ থাকার পর ২০২২ সালে এটা নিয়ে তেমন আলোচনা না হলেও চলতি বছর হজের খরচ দেড় লাখ টাকা বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে এ প্যাকেজ চালুর উদ্যোগ নেয় ধর্ম মন্ত্রণালয়।
হজ অনুবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, মক্কার হেরেম শরিফ থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে আজিজিয়া এলাকা। সেখানে ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের হজযাত্রীরা অবস্থান করেন। বাংলাদেশিরা এখানে থাকতে চান না। কারণ, খাবার হোটেল ও যাতায়াতের সুব্যবস্থা না থাকা।
ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর হজের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ধর্ম মন্ত্রণালয়, ঢাকা ও সৌদি হজ অফিস এবং সৌদিস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা আজিজিয়া প্যাকেজের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে এলাকাটি সফরে যাবেন। সেখানে বিভিন্ন স্থানের বাসা ভাড়া, পরিবহন ও ক্যাটারিংসহ আনুষঙ্গিক খরচ যাচাই-বাছাই করবেন। পরে তথ্যগুলো মন্ত্রণালয়ে জমা দেবেন। আজিজিয়ার সঙ্গে বিদ্যমান অন্যান্য প্যাকেজের তুলনা করে এ প্যাকেজের খরচ নির্ধারণ করবে মন্ত্রণালয়।
নতুন এ প্যাকেজে বিমান ভাড়া, আবাসনসহ অন্যান্য খরচ সমন্বয় করলে এক থেকে দেড় লাখ টাকা কমে যাবে। এটা হলে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকার মধ্যে হজ করা সম্ভব হবে। ফলে অনেকেই হজে যাওয়ার সাহস দেখাবেন— মনে করছেন হজ অনুবিভাগের কর্মকর্তারা।
তাদের মতে, সৌদি সরকারের বিশেষ আগ্রহে ‘আজিজিয়া প্যাকেজ’ আনার পরিকল্পনা করেছে বাংলাদেশ। সৌদি সরকার চাচ্ছে আজিজিয়া এলাকা হজযাত্রীদের আবাসনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে। সেজন্য গত কয়েক বছর ধরে আজিজিয়া এলাকায় নতুন নতুন ভবন ও হোটেল নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে দেশটির সরকার। প্রচুর ভবনও নির্মিত হয়েছে। ভারতীয় ও পাকিস্তানিরা সেখানে খাবারের হোটেল দিলেও বাংলাদেশি খাবার হোটেল সেভাবে গড়ে ওঠেনি।
এ প্যাকেজের বিষয়ে জানতে চাইলে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (হজ অনুবিভাগ) মতিউল ইসলাম বলেন, ‘যারা হেরেম শরিফ থেকে একটু দূরে থাকতে চান তাদের জন্য এ প্যাকেজের চিন্তা করা হচ্ছে। হজের আনুষ্ঠানিকতা শেষ একটি টিম আজিজিয়া প্যাকেজ নিয়ে কাজ শুরু করবে। যেহেতু চলতি বছর হজের খরচ অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে, সামনে এর খরচ কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই বিকল্প হিসেবে এ প্যাকেজের কথা চিন্তা করা হচ্ছে। সম্প্রতি সৌদি আরব সফরে এ বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে।’
কর্মকর্তারা বলছেন, আজিজিয়া প্যাকেজের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের বেশ আগ্রহ রয়েছে। খরচ কম হওয়ায় ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াসহ বেশকিছু দেশ তাদের সিংহভাগ হজযাত্রীর আবাসন ব্যবস্থা এখানে করে। ফলে সেসব দেশের হাজিরা তুলনামূলক কম খরচে হজ করতে পারেন। আজিজিয়া প্যাকেজ বাস্তবায়ন করা গেলে সেখানে সার্বক্ষণিক শাটল গাড়ি এবং খাবারের জন্য ক্যাটারিং সার্ভিস থাকবে। কেউ যদি নিজে রান্না করে খেতে চান সেই ব্যবস্থাও সেখানে থাকবে।
চলতি বছর খরচ বাড়ার নেপথ্যে
চলতি বছর সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজের খরচ ধরা হয় ছয় লাখ ৮৩ হাজার ১৫ টাকা। বেসরকারিভাবে সর্বনিম্ন খরচ ধরা হয় ছয় লাখ ৭২ হাজার ৬১৮ টাকা। হজ প্যাকেজের ১৬ ধাপের মধ্যে মোটা দাগে বিমান ও বাড়ি ভাড়ার পেছনে বেশি অর্থ ব্যয় হয়। এর মধ্যে বিমান ভাড়া এক লাখ ৯৭ হাজার ৭৯৭ টাকা এবং মক্কা ও মদিনায় বাড়ি ভাড়া বাবদ দুই লাখ চার হাজার ৪৪৪ টাকা খরচ হয়। এ দুই খাতের মোট খরচ দাঁড়ায় চার লাখ চার হাজার টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ দুই খাতের খরচ কমিয়ে আনতে পারলে হজের খরচ প্রায় দুই লাখ টাকা কমিয়ে আনা সম্ভব।
তাদের মতে, সরকার ঘোষিত হজ প্যাকেজের দাম বাড়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে সৌদি আরবের হারাম শরিফের কাছে বাড়ি ভাড়া ও বিমান ভাড়ার পেছনে। এ ক্ষেত্রে বিমান ভাড়া কমাতে পারে সরকার। বাড়ি ভাড়া কমানোর পেছনে বাংলাদেশ সরকারের সরাসরি কোনো হাত নেই। এ ক্ষেত্রে দূরবর্তী স্থানে বাড়ি ভাড়ার ব্যবস্থা করলে খরচ কমিয়ে আনা সম্ভব। সরকারিভাবে এটি করতে পারলে বেসরকারি এজেন্সিগুলোও কম দামের প্যাকেজ ঘোষণা করতে বাধ্য হবে।
অথচ মন্ত্রণালয় ও হজ এজেন্সির বাণিজ্যিক বিশেষ সুবিধার বিষয়টি মাথায় রেখে এমন উদ্যোগ নিতে পারেনি মন্ত্রণালয়। কারণ, মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট অনেক কর্মকর্তা ও এজেন্সিমালিক হজের সময় মক্কা-মদিনায় আবাসন ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন।
আরও যেসব খাতে খরচ হয়
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, হজের খরচ দুটি অংশে বিভক্ত। একটি সৌদির অংশ, অন্যটি বাংলাদেশের অংশ। সৌদি অংশে রয়েছে- বাড়ি ভাড়া, যার পেছনে ব্যয় দুই লাখ চার হাজার ৪৪৪ টাকা; মুজদালিফায় মোয়াল্লেম সেবা এক লাখ ৬০ হাজার ৬৩০ টাকা; জেদ্দা-মক্কা-মদিনা ও আল-মাশায়েরে পরিবহন ব্যয় ৩৫ হাজার ১৬২ টাকা; উন্নত মানের বাস সার্ভিসের পেছনে দুই হাজার ৮৩৯ টাকা; জমজম পানির পেছনে ৪২৫ টাকা; পবিত্র হজের পাঁচ দিন মিনা, আরাফাত ও মক্কা রুট সার্ভিস (লাগেজ পরিবহন) ৫৮৭ টাকা; মিনা, আরাফাত ও মুজদালিফায় যাতায়াতের জন্য অতিরিক্ত বাস ভাড়া ১৯ হাজার ৩৩৩ টাকা, দেশে প্রত্যাবর্তনকালে লাগেজ পরিবহন ব্যয় ৮৫১ টাকা, ভিসা ফি পাঁচ হাজার ৮১৭ টাকা, স্বাস্থ্যবিমা বাবদ সৌদি সরকারের ফি ৯৪৬ টকা। সবমিলিয়ে চার লাখ ৩৩ হাজার ৭৩৯ টাকা।
বাংলাদেশ অংশের খরচের মধ্যে রয়েছে- বিমান ভাড়া এক লাখ ৯৭ হাজার ৭৯৭ টাকা। এর মধ্যে মূল বিমান ভাড়া এক লাখ ৮৩ হাজার ৯১০ টাকা এবং এজেন্ট ফি দুই হাজার ৬৫০ টাকা। আইডি কার্ড, লাগেজ ট্যাগ, আইটি সার্ভিস, মক্কা রোড সার্ভিস মিলিয়ে ৮০০ টাকা; হজযাত্রীদের কল্যাণ তহবিল বাবদ ২০০ টাকা; প্রশিক্ষণ ফি ৩০০ টাকা; খাবার খরচ ৩৫ হাজার টাকা এবং হজ গাইড ফি ১৫ হাজার ১৭৮ টাকা।
সরকারি ও বেসরকারি উভয় প্যাকেজের সঙ্গে যুক্ত হয় কোরবানির খরচ। যদিও পরে সরকারি ও বেসরকারি দুই প্যাকেজেই ১১ হাজার ২৭৫ টাকা করে কমানো হয়।
জাহাজে করে হজে যাওয়ার পরিকল্পনা
আশির দশকে বাংলাদেশ থেকে জাহাজে করে সৌদি আরবে যেতেন হজযাত্রীরা। তখন জাহাজে করে যেতে–আসতে সময় লাগত তিন মাস। এর আগে ভারতের মুম্বাই থেকে জাহাজে হজ করতে যেতেন হাজিরা। সময়ের পরিক্রমায় তা বন্ধ হয়ে যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে হজের খরচ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ বিমান ভাড়া। এ খাতে খরচ কমাতে যাত্রীদের সমুদ্রপথে হজে নিয়ে যেতে চায় কর্ণফুলী শিপ বিল্ডার্স লিমিটেড নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এজন্য তারা নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে।
আবেদনে তারা বলেছে, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সৌদি আরবের জেদ্দা বন্দরে যেতে জাহাজে সময় লাগবে ১০ দিন। যাওয়া-আসা এবং হজের আনুষ্ঠানিকতা মিলিয়ে একজন হজযাত্রীর মোট সময় লাগবে ৩৭ দিন। জাহাজে গেলে উড়োজাহাজের চেয়ে এক থেকে দেড় লাখ টাকা খরচ কম হবে।
তাদের আবেদন নিয়ে পক্ষে–বিপক্ষে মতামত আসলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে তা পাঠানো হয়েছে। এ বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া পেলে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সৌদি আরব সরকারের কাছে প্রস্তাবটি পাঠানো হবে।
এ বিষয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মতিউল ইসলাম বলেন, জাহাজে করে বাংলাদেশ থেকে হজযাত্রার বিষয়ে যে আলোচনা নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে হচ্ছে, সেটা খুবই প্রাথমিক স্তরে রয়েছে। শিগগিরি এটি সম্ভব নয়।
পিএসএন/এমঅাই