বিরল রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে বিজয়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প এমন এক সময়ে আবারও হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন, যখন বিশ্বের দুটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে ভয়ানক যুদ্ধ চলছে। গাজা, লেবানন ও ইউক্রেনে প্রতিদিনই রক্ত ঝরছে। এ বাস্তবতায় ট্রাম্প প্রশাসন কী পদক্ষেপ নেবে, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কেমন হবে– এ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ, রাশিয়া, চীন, ভারত ও উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে তাঁর প্রশাসনের সম্পর্কের দিকে সবার নজর থাকবে।
ট্রাম্প বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ বন্ধের অঙ্গীকার নিয়ে আবার ক্ষমতায় এসেছেন। তিনি রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় যেতে পারেন। আগের মেয়াদে চীনকে ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে ছিলেন ট্রাম্প। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না বলেই মনে করা হচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ভালো সম্পর্কের কথা বলেছেন। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ছাড় না দেওয়ারও ইঙ্গিত দিয়েছেন।
আগামী জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট পদে শপথ নেবেন ট্রাম্প। তখন মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেট ও নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে তাঁর দল রিপাবলিকান পার্টি। তাঁর বিজয় অনেককে খুশি করলেও ইউরোপের দেশগুলোর কপালে ফেলেছে উদ্বেগের ভাঁজ। ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আর্থিক ও সামরিক সহযোগিতা দিয়ে আসছিল যুক্তরাষ্ট্র। এবার ট্রাম্প ওই সহায়তা বন্ধ করে দিতে পারেন। তাঁর মেয়াদে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের তিক্ততা কমতে পারে।
বুধবার দ্য কনভারজেশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, একটি যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছানোর জন্য ট্রাম্প কিয়েভ ও মস্কোকে চাপ দিতে পারেন। এর মাধ্যমে তা একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতির দিকে যেতে পারে। এটি হতে পারে রাশিয়াকে ইউক্রেনের ভূমিছাড়ের মধ্য দিয়ে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত না করতে ভ্লাদিমির পুতিনের দাবিও তিনি মেনে নিতে পারেন। এমনটা হলে তা ন্যাটোর ইউরোপীয় মিত্রদের অসন্তুষ্ট করবে। জোট ছাড়ার হুমকি দিয়ে ইউক্রেন নিয়ে পুতিনের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছাতে ইউরোপের দেশগুলোকে চাপও দিতে পারেন ট্রাম্প।
মধ্যপ্রাচ্যের প্রসঙ্গ এলে ট্রাম্পকে ইসরায়েল ও সৌদি আরবের কট্টর সমর্থক হিসেবে দেখা যায়। আগের মেয়াদে তিনি এমনটাই দেখিয়েছেন। ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের দ্বন্দ্ব বাড়ার প্রেক্ষাপটে এবার তিনি সে প্রচেষ্টাকে দ্বিগুণ করতে পারেন। তিনি ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপে যেতে পারেন। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা আরও বাড়তে পারে। নেতানিয়াহু অবাধে তাঁর আক্রমণ-আগ্রাসন চালিয়ে যেতে পারেন।
সম্প্রতি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালেন্টকে বরখাস্ত করেন। গাজা যুদ্ধের একজন সমালোচক ছিলেন গ্যালেন্ট। তাঁকে বরখাস্ত করে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার বার্তাই দিয়েছেন নেতানিয়াহু। ট্রাম্পের বিজয় কার্যত মধ্যপ্রাচ্যে নেতানিয়াহুর হাত শক্তিশালী করেছে।
দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে পারেন। রয়টার্স লিখেছে, গত সেপ্টেম্বরে নির্বাচনী প্রচারণা চলাকালে ট্রাম্প ফ্লোরিডায় তাঁর বাসস্থান মার-এ-লাগোতে কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের আমিরদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সৌদি আরবের সঙ্গে কূটনৈতিক আলাপ চালিয়ে যান ট্রাম্পের জামাতা জেরাড কুশনার। উপসাগরীয় দেশ ওমানে চার বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগও করতে যাচ্ছে ট্রাম্প অর্গানাইজেশন।
মধ্যপ্রাচ্য ও ইউক্রেন ইস্যুতে জো বাইডেন প্রশাসনের চেয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি ভিন্ন হলেও চীনের ক্ষেত্রে তা হয়তো বদলাচ্ছে না। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। ২০১৬ সালে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে চীনের বিরুদ্ধে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, বাইডেন প্রশাসন সেগুলো থেকে সরে আসেনি। এবার মনে করা হচ্ছে, চীনের প্রতি দ্বিগুণ কঠোর হতে যাচ্ছেন দ্বিতীয় মেয়াদের ট্রাম্প। তিনি চীনের পণ্য আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে দিতে পারেন। এরই মধ্যে ট্রাম্প এটাকে ‘বিশাল ব্যাপার’ হবে বলে বর্ণনা করেছেন। তবে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বস্তুনিষ্ঠ আলোচনার পথও খোলা রাখবেন। এ অবস্থায় ইউরোপীয় মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্কের মতো তাইওয়ানকে নিরাপত্তা দিতে মার্কিন অঙ্গীকার ট্রাম্পের সময়ে প্রশ্নের মুখে পড়বে; ফিলিপাইন, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান প্রসঙ্গ তো আছেই।
প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সঙ্গে সিঙ্গাপুরে এক সম্মেলনে বৈঠক করেন। দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক দা-কুমড়ার। এবারও ট্রাম্প এ সম্পর্ক নিয়ে কাজ করতে পারেন। এশিয়ার বিভিন্ন দেশে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। এসব দেশ কোন দিকে ঝুঁকবে, সেটাই দেখার বিষয়। এই দেশগুলোর মধ্যে ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার নাম শোনা যাচ্ছে।
ট্রাম্প যাতে জয়ী হন, সে জন্য ভারতে এবারও হিন্দুত্ববাদীরা পূজা করেছেন। ট্রাম্পের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সম্পর্কও ভালো বলেই ধরে নেওয়া হয়। ট্রাম্প তাঁর প্রচারণায় মোদিকে ‘বন্ধু’ বলে প্রশংসাও করেছেন। বিজয়ের পর ট্রাম্পকে সবার আগে অভিনন্দন জানিয়েছেন মোদি। কিন্তু অতঃপর বিগত মেয়াদের চেয়ে এবার চিত্রটা একটু ভিন্ন হতে পারে। ট্রাম্পের কথায় সে ইঙ্গিত রয়েছে। গত অক্টোবরে তিনি ভারতের শুল্কনীতির সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ভারত বিদেশি পণ্যের ওপর উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করে। নির্বাচনে জয়ী হলে তিনিও পাল্টা ভারতীয় পণ্যে উচ্চ শুল্ক আরোপ করবেন। ট্রাম্পের নীতি ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ (প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র)। কার্যত তাঁর পররাষ্ট্রনীতিসহ সব বিষয়েই এ নীতির বহিঃপ্রকাশ দেখা যাবে।