হজযাত্রীদের পাশাপাশি এবার ওমরাহ ও ভিজিট ভিসার যাত্রীদের জন্যও স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও টিকা (মেনিনজাইটিস ও ইনফ্লুয়েঞ্জা) বাধ্যতামূলক করেছে সৌদি আরব। আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। এ টিকা নিতে হবে যাত্রার অন্তত ১০ দিন আগে। হঠাৎ করে সৌদি সরকারের এমন সিদ্ধান্তে বেকায়দায় পড়েছেন ওমরাহযাত্রী ও এজেন্সিগুলো। টিকার জন্য এদিক-সেদিক ঘুরে অনেকেই শেষ পর্যন্ত ওমরাহ যাত্রাই বাতিল করে দিচ্ছেন।
এমন অবস্থায় টিকা নিয়ে তৈরি এই সংকট কাটার আভাস দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। মূলত দেশীয় প্রতিষ্ঠান ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের তৈরি টিকা ইনগোভ্যাক্সের ওপর ভরসা করেই সংকট কাটার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ২৮ জানুয়ারির পর থেকে মেনিনজাইটিস ও ইনফ্লুয়েঞ্জার এই টিকা সহজেই মিলবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর। সিভিল সার্জন অফিসের মাধ্যমে এই টিকা জেলা শহরেও পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
তবে এই টিকা সরকারিভাবে দেওয়া হবে না। অর্থাৎ প্রত্যেককে কিনে নিতে হবে টিকা। এর মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার টাকা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর ঢাকা পোস্টকে বলেন, ওমরাহের ক্ষেত্রে যদিও আমরা টিকা কার্যক্রমের ব্যবস্থাপনা করছি, কিন্তু এটা সরকারিভাবে দেওয়া হবে না। বেসরকারিভাবে প্রত্যেককে কিনে নিতে হবে। আমরা ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের সঙ্গে চুক্তি করেছি। তাদের তৈরি ‘ইনগোভ্যাক্স’ টিকাটি ১০০০ টাকায় নেওয়া যাবে। তবে এর বাইরেও আরও অনেকগুলো কোম্পানির টিকা বাজারে রয়েছে। যে কেউ চাইলে একটু বেশি দামে অন্য যে কোনো টিকাও নিতে পারবেন। আমরা এ ক্ষেত্রে কোনো বাধ্যবাধকতা রাখছি না।
এই টিকার বিষয়ে জানতে চাইলে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের সিনিয়র ম্যানেজার ফারহানা লাইজু ঢাকা পোস্টকে বলেন, সৌদিগামী যাত্রীদের মেনিনজাইটিস ও ইনফ্লুয়েঞ্জার জন্য আমাদের টিকাটির নাম ইনগোভ্যাক্স এসিডব্লিউওয়াই। আমাদের হাতে পর্যাপ্ত টিকা আছে। ইতোমধ্যে ৮ হাজার টিকা বাজারে আছে। এ ছাড়াও ৪০ হাজার টিকা স্টকে আছে। এমনকি আগামী মার্চের মধ্যে আরও ৪০ হাজার ডোজ টিকা তৈরি হয়ে যাবে। প্রতি মাসেই ৪০ হাজার ডোজ টিকা তৈরি করার সক্ষমতা আমাদের আছে। সুতরাং টিকা নিয়ে আমরা কোনো ধরনের চিন্তা করছি না। টিকার কোনো সংকট নেই।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যেই রাজধানীর বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের থেকে এই টিকা কিনে নিয়েছে। বিশেষ করে ল্যাবএইড, প্রাভা হেলথ, ভাইরোলজি ডিপার্টমেন্ট (বিএসএমএমইউ), প্রিভেন্টাসহ অন্যান্য বেশ কয়েকটি ভ্যাকসিন সেন্টারে এই টিকা পাওয়া যাচ্ছে।
সৌদি আরবের নির্দেশনা অনুযায়ী ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে যারা পবিত্র ওমরাহ ও ভিজিট ভিসায় দেশটিতে যাবেন, তাদের বাধ্যতামূলক মেনিনজাইটিস ও ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা নিতে হবে। এর আগে যারা যাবেন তাদের এই টিকা নেওয়া বাধ্যতামূলক নয়।
হজযাত্রীদের জন্য মেনিনজাইটিস ও ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা সরকারের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিজস্ব বাজেট থেকে এ টিকা দিয়ে থাকে। এতে হজযাত্রী প্রতি সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা ভর্তুকি দিতে হয়। তবে হঠাৎ করেই ওমরাহ এবং ভিজিট ভিসার যাত্রীদের জন্য সৌদি সরকার টিকা বাধ্যতামূলক করায় দুশ্চিন্তা-দুর্ভোগ দেখা দেয়।
ওমরাহ এবং ভিজিট ভিসায় সৌদি ভ্রমণে ইচ্ছুকদের জন্য মেনিনজাইটিসের টিকা বাধ্যতামূলক করায় হঠাৎ করে বেড়ে যায় টিকার চাহিদা। তৈরি হয় টিকার সংকট। বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে টিকা না পেয়ে গত মঙ্গলবার রাজধানীর পান্থপথ এলাকায় সড়ক অবরোধ করে আন্দোলনও করেন সৌদি প্রবাসীরা। পরে সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়— প্রবাসী শ্রমিকদের টিকার বাধ্যবাধকতা নেই।
‘এ বছর আর ওমরাহে যাওয়া হচ্ছে না’
রাজধানীর রামপুরা বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা মো. মোহাম্মদ মনির হোসেন। পরিবার নিয়ে আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি তার সৌদি আরবে ওমরাহ করতে যাওয়ার কথা। ভিসা ও বিমানের টিকিট কাটাও হয়ে গেছে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এজেন্সির মাধ্যমে জানতে পারেন যে, যাত্রার ১০ দিন আগে তাকে মেনিনজাইটিস ও ইনফ্লুয়েঞ্জা টিকা নিতে হবে। এ টিকার খোঁজ করতে গিয়ে কোনো কূল-কিনারা করতে পারেননি। সবশেষ তিনি বিমানের টিকিট বাতিল করেছেন।
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এ বছর আর ওমরাহে যাওয়া হচ্ছে না। টিকার জন্য দুইদিন অনেক ঘুরেছি। শেষ পর্যন্ত টিকিট বাতিল করেছি। টিকার বিষয়ে যদি ধর্ম মন্ত্রণালয় বা সরকার আগেই সিদ্ধান্ত নিতো তাহলে হয়তো এমনটা হতো না।
মনির হোসেনের মতোই ৫ ফেব্রুয়ারি ওমরাহ করতে যাওয়ার কথা ঢাকার উত্তরার খাইরুল ইসলামের। তিনি বলেন, আমার টিকিট কাটা আছে। আমাদের (ট্রাভেল) এজেন্ট থেকে বলেছে, স্কয়ার হাসপাতালে গেলে টিকা নেওয়া যাবে। কিন্তু ওখানে গিয়ে দুইদিন ঘুরেছি। তারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে টিকা নেই। এরপর আরও কয়েক জায়গায় খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু বিষয়টা নিয়ে সরকারি কর্তৃপক্ষের কোনো তৎপরতা না দেখে টিকিট বাতিল করে দিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, আমি টিকিট বাতিল করেছি। এরপরই শুনেছি ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নাকি টিকা ছাড়াই যাওয়া যাবে। এরপর আবার আজ (বৃহস্পতিবার) শুনছি ওমরাহ করতে যাওয়াদের টিকা দেওয়াও শুরু হবে। শুধু শুধু টিকিটটা বাতিল করেছি। এ বছর আর যাওয়া হবে না।
শুধু মনির হোসেন আর খাইরুল ইসলামই নয়, হজ এজেন্সিগুলোতে টিকিট বাতিলের চেষ্টা করছেন আরও অসংখ্য ওমরাহযাত্রী। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এ বছর যারাই ওমরাহ করতে যাবেন, তাদের সবাই টিকা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
ক্ষতির মুখে এজেন্সি, অভিযোগ আগে জেনেও উদ্যোগ নেয়নি সরকার
টিকা নিয়ে শুধু সৌদিগামী যাত্রীরাই ভোগান্তিতে নয়, এজেন্সি কর্তৃপক্ষও ক্ষতির মুখে পড়েছেন। মক্কা-মদিনা হজ ট্যুর এজেন্সির ম্যানেজার মোজাফ্ফর হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, টিকা বাধ্যতামূলক— এ খবর জানার পর যারা ১০ ফেব্রুয়ারির পরে ওমরাহ করতে যাবেন, তাদের প্রায় সবাই ফোন দিচ্ছেন। আমরা কোনো জবাব দিতে পারছি না। অনেকেই টিকিটের তারিখ পরিবর্তন করে জানুয়ারিতে আনতে চাচ্ছেন। কিন্তু এর মধ্যে বিমানগুলোর ফ্লাইট পাওয়া যাচ্ছে না। পেলেও দ্বিগুণের বেশি ভাড়া চাওয়া হচ্ছে। বাধ্য হয়ে অনেকে টিকিট বাতিল করছেন।
তিনি আরও বলেন, ওমরাহ করতেও টিকা নিতে হবে— সৌদি সরকার এমন ঘোষণা তিন মাস আগে দিলেও বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এজেন্সি যোগাযোগ করলে ধর্ম মন্ত্রণালয় দায় এড়িয়ে যায়।
টিকা নিয়ে বিশৃঙ্খলার দায় কার?
হঠাৎ করেই সৌদি সরকারের টিকার সিদ্ধান্ত এবং পরবর্তীতে সৌদিগামী যাত্রীদের দুর্ভোগ-বিশৃঙ্খলার কোনো দায় নিতে রাজি নয় ধর্ম মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় বলছে, হজ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে মন্ত্রণালয় সরাসরি যুক্ত বিধায় হজযাত্রীদের দুটি টিকা ফ্রি দেওয়া হয়। কিন্তু ওমরাহ ব্যবস্থাপনায় সরকার বা মন্ত্রণালয়ের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তাই এ বিষয়ে সৌদি সরকারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
ধর্ম মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য অনুযায়ী, ওমরাহযাত্রীদের যাওয়া-আসার কোনো ক্ষেত্রেই ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ন্যূনতম সম্পৃক্ততা নেই। এমনকি সৌদি সরকার বা দূতাবাসও এ নিয়ে অফিসিয়ালি তাদের কিছু জানায়নি। ফলে আগ বাড়িয়ে এ নিয়ে তারা কোনো সিদ্ধান্তও নেবে না।
নাম প্রকাশ না করে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ওমরাহ নিয়ে সৌদি সরকার ও এজেন্সিগুলো ব্যবসা করছে। এখানে ধর্ম মন্ত্রণালয় কোনোভাবে সম্পৃক্ত নয়। সৌদি সরকার ও দূতাবাসকে ধর্ম মন্ত্রণালয় বারবার বলেছে যে, যারা ওমরাহ করতে যাবেন তাদের তথ্যগুলো যেন মন্ত্রণালয় পায় সেই ব্যবস্থা করা। শুধু তাই নয়, সবশেষে বলা হয়েছে যে, যারা ওমরাহ করতে যাবেন তারা মন্ত্রণালয়ের একটি ফরম পূরণ করে গেলেও সরকারের কাছে তথ্য থাকে। কিন্তু সেটি হয়নি। ফলে প্রতি বছর বা মাসে কতজন ওমরাহ করতে যান তার কোনো তথ্য সরকারের কাছে নেই।
এসব প্রসঙ্গে হজ অণুবিভাগের যুগ্ম সচিব মো. মঞ্জুরুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ওমরাহ হয় ব্যক্তি টু সৌদি সরকারের মধ্যে। সৌদি সরকার ভিসা দেয়, আর ব্যক্তি টিকিট কেটে চলে যান। এখানে মন্ত্রণালয়ের ন্যূনতম কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এখন টিকার ইস্যু সামনে আসতেই সবাই ধর্ম মন্ত্রণালয়কে দোষারোপ করছে। আমরা তো টিকা আমদানি বা বিক্রি করি না। এটি করবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। দ্বিতীয়ত, সৌদি সরকার ও দূতাবাস এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি। ফলে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের এখানে কার্যত কিছুই করার নেই।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর টিকা নিয়ে বিশৃঙ্খলা প্রসঙ্গে বলেন, সৌদি সরকারের হঠাৎ সিদ্ধান্তের কারণেই এমনটা হয়েছে। তবে আমরা নির্ধারিত সময়ের আগেই সবকিছু ব্যবস্থাপনা করে ফেলব। ইতোমধ্যে আমরা পুরোদমে কাজ শুরু করে দিয়েছি। টিকার জন্য যাত্রীদের ঢাকায় আসতে হবে না। সিভিল সার্জন অফিসের মাধ্যমে নিজ নিজ জেলাতেই টিকা নিতে পারবেন। আমরা সিভিল সার্জনদের মাধ্যমে আগেই টিকা নেওয়ার কেন্দ্র ঠিক করে দেবো। ওমরাহ হয় ব্যক্তি টু সৌদি সরকারের মধ্যে। সৌদি সরকার ভিসা দেয়, আর ব্যক্তি টিকিট কেটে চলে যান। এখানে মন্ত্রণালয়ের ন্যূনতম কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এখন টিকার ইস্যু সামনে আসতেই সবাই ধর্ম মন্ত্রণালয়কে দোষারোপ করছে।হজ অণুবিভাগের যুগ্ম সচিব মো. মঞ্জুরুল হক
নিবন্ধন ও সার্টিফিকেট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, টিকা কার্যক্রম শুরু করার আগে আমাদের কিছু প্রসিডিউর আছে। ওয়েবসাইটে টিকার নিবন্ধন, সার্টিফিকেটসহ কিছু কার্যক্রম নিয়ে আমাদের এমআইএস শাখা কাজ করছে। তারা আমাদের থেকে ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় নিয়েছে। আশা করছি এর মধ্যেই আমাদের সকল ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন হয়ে যাবে এবং আমরা এ মাসের শেষের দিকে টিকাদান কার্যক্রম শুরু করতে পারব।
তিনি আরও বলেন, আমরা বিষয়টিকে এমনভাবে সাজিয়েছি, যেন ওমরাহযাত্রীদের খুব বেশি ভোগান্তি পোহাতে না হয়। আমরা তাদের পাসপোর্টের সাথেই টিকা সার্টিফিকেটটি যুক্ত করে দেবো। যাতে এয়ারপোর্টে পাসপোর্ট দেখিয়ে যাত্রীরা কোনো ভোগান্তি ছাড়াই চলে যেতে পারেন।