পৃথিবীর সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গ যেন আকাশ ছুঁয়ে দেয়। মেঘমুক্ত আকাশে দেখা মেলে কাঞ্চনজঙ্ঘার নানা রূপ। হেমন্তের ঝকঝকে নীল আকাশে দৃশ্যমান হয় হিমালয়ের বরফে টুপি পরা অপরূপ ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’। প্রতিবছর অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে আসেন অসংখ্য পর্যটক।
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া সীমান্তের বুক চিরে প্রবাহিত নদীগুলোও বিভিন্ন ঋতুতে রূপ বদলায়। মহানন্দাও এর একটি। মহানন্দার তীরে দাঁড়িয়ে অপরূপ ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’য় মগ্ধ হন পর্যটকরা।
‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ কেন পর্যটকদের আকাঙ্খার মধ্যমণি?
হিমালয়ের দ্বিতীয় পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা। প্রতিবছর হিমালয়ের দেশ নেপালে ছুটে যান ভ্রমণপিপাসুরা। আর হিমালয়ের সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গ দেখতে ছুটেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিংয়ের টাইগার হিলে। সেখানে দাঁড়িয়ে অপরূপ কাঞ্চনজঙ্ঘায় মুগ্ধ হন পর্যটকরা। আবার অনেকে আরও কাছ থেকে দেখতে নেপালেই ছুটে যান। দিনের আলোতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানা রূপ মেলে ধরে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’। যে কারণে হিমালয়ের মাঝে সৌন্দর্য উপভোগে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ পর্যটকদের মধ্যমণি।
বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়েও নানা রূপে মুগ্ধ করা ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’র দেখা মেলে দেশের উত্তরের শেষ অংশ পঞ্চগড় থেকে। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত উত্তরের আকাশে মেঘ ও কুয়াশা না থাকায় মহানন্দার তীরে দাঁড়িয়ে উপভোগ করা যায় ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’র বর্ণিল রূপ।
কাঞ্চনজঙ্ঘার অবস্থান
কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতশৃঙ্গ নেপাল ও ভারতের সিকিম সীমান্তে অবস্থিত। বাংলাদেশের তেঁতুলিয়ার বাংলাবান্ধা ইউনিয়ন (স্থলবন্দর) থেকে নেপালের দূরত্ব ৬১ কিলোমিটার। ভারতের দার্জিলিংয়ের দূরত্ব ৫৮ কিলোমিটার। হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্টের দূরত্ব ৭৫ কিলোমিটার আর কাঞ্চনজঙ্ঘার দূরত্ব ১১ কিলোমিটার। পৃথিবীতে উচ্চতার দিক থেকে প্রথম তিনটি পর্বতই হিমালয় পর্বতমালায় অবস্থিত। প্রথম অবস্থানে রয়েছে মাউন্ট এভারেস্ট। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এভারেস্ট শৃঙ্গের উচ্চতা ৮ হাজার ৮৪৮ মিটার বা ২৯ হাজার ২৯ ফুট। আর দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা পর্বত কে-টুর উচ্চতা ৮ হাজার ৬১১ মিটার বা ২৮ হাজার ২৫১ ফুট। এর পরই অবস্থান ৮ হাজার ৫৮৬ মিটার উঁচু কাঞ্চনজঙ্ঘার।
‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’য় কেন এতো আকর্ষণ
মোহনীয় রূপে আচ্ছাদিত কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা পর্যটকদের দৃষ্টিতে—এ এক দারুণ অনুভূতি। কারণ ক্ষণে ক্ষণে বদলায় এর রঙ। ভোরে সূর্যোদয়ের সময় মনে হয় যেন কাঞ্চনজঙ্ঘার সাদা বরফ সোনায় ছেয়ে গেছে। কারণ দিনের প্রথম সূর্যকিরণ বরফে এমনভাবে প্রতিফলিত হয় তা দেখতে যেন সোনার পাহাড়। বেলা বাড়লে আবার সেই রূপ বদলায়। দিনের মধ্যভাগে মনে হয় প্রকান্ড মেঘ উত্তরের আকাশটা দখল করে দাঁড়িয়ে আছে। বিকেলের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ যেন লজ্জারাঙা। আর গোধূলিবেলায় পুরো কাঞ্চনজঙ্ঘা আবির খেলায় মেতে ওঠে।
আলোকচিত্রীর চোখে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’
কাঞ্চনজঙ্ঘার মনোমুগ্ধকর ছবি তুলেন আলোকচিত্রী ফিরোজ আল সাবাহ। তিনি বলেন, আমি ২০১০ সাল থেকে ডিজিটাল ক্যামেরায় এই শৃঙ্গের ছবি তুলে আসছি। এ অঞ্চলের সৌন্দর্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। উত্তরে চোখ গেলেই দেখতে পাবেন খোলা মাঠের ফাঁক দিয়ে চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে শ্বেত শুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা। পাহাড়টির সৌন্দর্য উপভোগ করার মোক্ষম সময় ভোর ও বিকেল বেলা। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নানান রঙ নিয়ে হাজির হয় বরফে আচ্ছাদিত এ পর্বতচূড়া। কখনো শুভ্র, কখনো গোলাপি, আবার কখনো লাল রঙ। ভোরের আলো ফুটতেই তা গিয়ে পড়ে ঠিক কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায়। চারপাশে আবছা অন্ধকার থাকলেও চকচক করে চূড়াটি। ভোরের আলোয় এবং বিকেল পর্বত চূড়াটি পোড়া মাটির রঙ নেয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু ঝাপসা হয়ে আসে। তখন রং হয় সাদা। দূর থেকে মনে হয় এ যেন আকাশের গায়ে খন্ড বরফ।
যখন-যেখান থেকে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ভালো উপভোগ করবেন
অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত হালকা শীতে পরিষ্কার আকাশে এই পর্বত চূড়া দেখা যায়। জেলার বিভিন্ন পয়েন্টের মধ্যে তেঁতুলিয়া থেকেই বেশ ভালো দেখা যায়। জেলা পরিষদ ডাকবাংলো, মহানন্দা নদীর তীর, বাংলাবান্ধা জিরোপয়েন্ট, শালবাহান রওশনপুর, কালিতলা ব্রীজ, ডাহুক সেতু, ভেরসা, চাওয়াই, করতোয়া সেতুসহ বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে খালি চোখে দেখা মেলে। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ উপভোগ করতে তেঁতুলিয়া উপজেলা প্রশাসন একটি ওয়াচ টাওয়ারও নির্মাণ করেছে।
উত্তরের এ জেলা জুড়ে আছে পর্যটনের আরও যেসব রসদ
কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতশৃঙ্গ পর্যটনে বড়মাত্রা যুক্ত করলে পঞ্চগড়ের প্রকৃতি জুড়ে রয়েছে পর্যটনের নানান রসদ। প্রাচীন স্থাপনা, প্রত্ন পর্যটন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, পুণ্ড, গুপ্ত, পাল, সেন ও মুসলিম শাসনামলের হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এ জেলা। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। দেশের একমাত্র চারদেশীয় স্থলবন্দর এ জেলায়। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর, ইমিগ্রেশন ও জিরো পয়েন্ট, বিজিবি-বিএসফের জয়েন্ট রিট্রিট সেরিমনি, ইংরেজ আমলে জেলা পরিষদ ডাকবাংলো, সমতল ভূমির চা বাগান, টিউলিপ গার্ডেন, আনন্দধারা পার্ক, ভিতরগড় দূর্গনগরী, মহারাজা দিঘী, পাথরের জাদুঘর, মোগল স্থাপনা মির্জাপুর শাহী মসজিদ, বোদেশ্বরী পীঠ মন্দিরসব বিভিন্ন ঐতিহ্য নিয়ে পর্যটনে সমৃদ্ধ এ জেলা। পর্যটনের সব উপাদান মিলে অপরূপ সৌন্দর্যের কারণে দিন দিন ভ্রমণপিপাসুদের কাছে পঞ্চগড়ের কদর বাড়ছে।
গড়ে উঠেছে আবাসিক হোটেল ও রেস্টুরেন্ট
কাঞ্চনজঙ্ঘা ও জেলার পর্যটনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু আবাসিক হোটেল। গত কয়েক বছরে তেঁতুলিয়ায় গড়ে উঠা ইএসডিওর মহানন্দা কটেজ, কাজী ব্রাদাস, স্কয়ার আবাসিক. আবাসিক দোয়েল. সীমান্তের পাড়, আবাসিক কাঞ্চনজঙ্ঘাসহ বেশ কিছু আবাসিক হোটেল পর্যটকদের সেবা দিচ্ছে। সরকারিভাবে রয়েছে আবাসন ব্যবস্থা। রেস্টুরেন্টের মধ্যে বাংলা, নুরজাহান, জান্নাত, ভাইভাইসহ অনেক হোটেল গড়ে উঠেছে।
পর্যটক সেবা, হোটেল-রেস্টুরেন্ট ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
কাঞ্চনজঙ্ঘা ও জেলার পর্যটনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু আবাসিক হোটেল। এছাড়া জেলায় পর্যটকদের সেবা দিচ্ছে পর্যটন সেবা প্রদানকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও পর্যটকদের নির্ভিঘ্নে ভ্রমণের জন্য নিরাপত্তাসহ যাবতীয় সেবা দিচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন। সম্প্রতি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় স্থাপিত হয়েছে ট্যুরিস্ট পুলিশ পঞ্চগড় জোন। পর্যটকদের নিরাপত্তাসহ তাদের সমস্যা নিরসনে তারা কাজ করছে।
জেলার পর্যটন ঘিরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে স্থানীয় অর্থনীতি। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজারো পর্যটকের সমাগম ঘটে এ জেলায়। বিশেষ করে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে অক্টোবর ও নভেম্বর মাস জুড়ে পর্যটকের ভিড়ে মুখরিত থাকে তেঁতুলিয়া। এতে ব্যস্ততা বেড়ে যায় হোটেল-রেস্তোরাঁগুলোতে। গতি পায় তিন চাকার ভ্যান আর অটোরিকশার মতো যানগুলোও। ব্যস্ত সময় পার করেন পর্যটক সেবা দেওয়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে দিন দিন সমৃদ্ধ হচ্ছে স্থানীয় অর্থনীতি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফজলে রাব্বী বলেন, কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতশৃঙ্ঘ দেখতে হেমন্ত-শীত সময়ে দূর দূরান্ত থেকে পর্যটকরা ছুটে আসেন পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায়। এই সময়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা চমৎকার দেখা যায়। সেই সঙ্গে পঞ্চগড়ের সমতলের চা শিল্পসহ অনেক পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে। পর্যটকরা যেন নির্বিঘ্নে তাদের ভ্রমণ উপভোগ করতে পারেন সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়া পর্যটকদের থাকার জন্য তেঁতুলিয়া ডাক বাংলোতে পুরনো দুটি ভবনের পাশাপাশি বেরং কমপ্লেক্স নামে নতুন আরেকটি বাংলো নির্মাণ করা হয়েছে। আশা করি পর্যটকরা পঞ্চগড়ে তাদের ভ্রমণ উপভোগ করতে পারবেন।