১৯৮৩ সালে দেশে প্রথম চালু হয় ইসলামি ব্যাংকিং। এখন এ ধরনের ব্যাংক আছে ১০টি। দেশের ইসলামি ব্যাংকিং নিয়ে আছে আলোচনা-সমালোচনা ও জিজ্ঞাসা। এ সব নিয়ে আজ রইলো প্রতিবেদন।
প্রচলিত ব্যাংকে আমানত রাখলে যে পরিমাণ সুদ পাওয়া যায়, ইসলামি ব্যাংকগুলো সচরাচর তারচেয়ে বেশি মুনাফা দেয় না। তবু আমানতকারীরা ঝুঁকছে ইসলামি ব্যাংকগুলোর দিকেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে সাধারণ গ্রাহকরা সবচেয়ে বেশি আমানত রেখেছেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডে। শুধু তাই নয়, করোনাভাইরাসের কারণে ব্যাংক খাতে যখন টাকার সংকট, তখন প্রথম ব্যাংক হিসেবে ইসলামী ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এমনকি আমানতের হিসাবে শীর্ষ পাঁচটি ব্যাংকের মধ্যে তিনটিই ইসলামি ধারার ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে আরও জানা গেছে, বেসরকারি খাতের তৃতীয় ও চতুর্থ সর্বোচ্চ আমানত রয়েছে যথাক্রমে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের আমানত প্রায় এক লাখ ৩৯ হাজার কোটি টাকা। তথ্য বলছে, করোনাকালের দুই বছরেই ব্যাংকটির আমানত বেড়েছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। ২০১৮ সালের শুরুতে ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ ছিল ৭৫ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা।
জানা গেছে, বিশ্বে ব্যাংক ব্যবস্থা ৬০০ বছর আগে যাত্রা শুরু করলেও ইসলামি ধারার ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু হয় ১৯৬৩ সালে। বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিং চালু হয় ১৯৮৩ সালে। দেশি-বিদেশি উদ্যোগ ও সরকারি-বেসরকারি মালিকানায় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশে ইসলামি ব্যাংকিং শুরু।
ধর্মীয় কারণেই ইসলামি ব্যাংক
ইসলামী ব্যাংকের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বললেন, ‘যারা জাহান্নামের আগুনকে ভয় পায়, তারা সুদমুক্ত মনে করেই ইসলামি ব্যাংকিং বেছে নেন। বেশি মুনাফা বা লাভের আশা তারা করেন না। তবে ইসলামী ব্যাংক গ্রাহকদের কখনও ঠকায় না। যে কারণে একবার কোনও গ্রাহক ইসলামী ব্যাংকে এলে অন্য ব্যাংকে যান না।’
ব্যাংকটির আরেক কর্মকর্তা জানান, ‘ইসলামী ব্যাংকে অনিয়ম-দুর্নীতি কম হয়। আমানত হারানোর ভয়ও নেই। এ ছাড়া ব্যাংকটি শতভাগ সুদমুক্ত। প্রচলিত ব্যাংকগুলোর নির্ধারিত সুদ হারের কাছাকাছি বা তারচেয়েও কম মুনাফা এলেও চূড়ান্ত হার নির্ধারণ করে দেয় না। তবে বছর শেষে বা মেয়াদ শেষে ঠিকই গ্রাহকদের অন্য যেকোনও ব্যাংকের চেয়ে বেশি মুনাফা দেয়। এ কারণে ব্যাংকটিতে আমানতকারী বেড়েছে। এখন ব্যাংকটিতে এক কোটি ৬৬ লাখেরও বেশি আমানতকারী রয়েছেন।’
ধারেকাছেও নেই অন্যরা
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুদের অফার করছে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, কৃষি ব্যাংক ও বেসিক ব্যাংক। অথচ এই ব্যাংক তিনটিতে টাকা রাখার প্রতি গ্রাহকদের আগ্রহ নেই। একইভাবে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সুদ দিচ্ছে পদ্মা (সাবেক ফারমার্স) ব্যাংক। ব্যাংকটি তিন থেকে ছয় মাসের কম সময়ের আমানতে সুদ দিচ্ছে ৭ শতাংশ হারে।
অপরদিকে ইসলামী ব্যাংক আমানতের বিপরীতে সম্ভাব্য মুনাফা ঘোষণা করেছে ৬ শতাংশেরও নিচে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বেসরকারি খাতের অন্য কোনও ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকের ধারেকাছেও নেই। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আমানত রয়েছে পূবালী ব্যাংক লিমিটেডের। ২০২১ সাল শেষে ব্যাংকটির আমানত দাঁড়িয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকায়। অর্থাৎ দ্বিতীয় সর্বোচ্চর চেয়ে ইসলামী ব্যাংকের আমানত তিনগুণেরও বেশি।
আবার বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি আমানত আছে মাত্র চারটি ব্যাংকের। সেগুলোর মধ্যে দুটিই ইসলামি ধারার। তৃতীয় সর্বোচ্চ আমানত রয়েছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে, আর চতুর্থ সর্বোচ্চ আমানত রয়েছে এক্সিম ব্যাংকে। আর পঞ্চম সর্বোচ্চ আমানত রয়েছে ন্যাশনাল ব্যাংকে।
২০২১ সালে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে দেশে আমদানি হয়েছে ৬৪ হাজার ৫৩০ কোটি টাকার পণ্য। একই সময়ে এ ব্যাংকের মাধ্যমে দেশ থেকে ৩০ হাজার ১৭৮ কোটি টাকার পণ্য রফতানি হয়েছে। ২০২১ সালে ইসলামী ব্যাংক একাই ৫০ হাজার ৫১৮ কোটি টাকার রেমিট্যান্স দেশে এনেছে। সব মিলিয়ে বিদায়ী বছরে ব্যাংকটির বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ২২৬ কোটি টাকা।
গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটি ১ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ বা ঋণ দিয়েছে। এখন ১৮ লাখ গ্রাহক এ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। সারা দেশে ৩৮৪টি শাখা, ২১৯টি উপশাখা, ২ হাজার ৬৭৮ এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট ও ২ হাজার ৩১৮টি এটিএম ও সিআরএম বুথ রয়েছে ইসলামী ব্যাংকের।
ছোট গ্রাহকদের আস্থা বেশি
ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বলছেন, ‘ইসলামী ব্যাংকের মূল সম্পদ হলো গ্রাহক। গ্রাহকদের ভালোবাসায় ইসলামী ব্যাংক আজ এ পর্যায়ে। তারাই ইসলামী ব্যাংকের অ্যাম্বাসেডর। সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকের কর্মীরা নিজেদের সর্বোচ্চটুকুই দিয়ে থাকেন। কর্মীদের সততা, আত্মোৎসর্গের মানসিকতা ও পেশাদারিত্ব এ ব্যাংককে দেশের মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে দিতে সহযোগিতা করেছে।’
প্রচলিত ব্যাংকের একাধিক এমডি স্বীকার করেছেন, মুসলমান প্রধান দেশ হওয়ায় ছোট আমানতকারীরা তাদের টাকা রাখার ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংককেই প্রথমে বেছে নেন। এক্ষেত্রে তাদের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতিটাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তারা আরও মনে করেন, যেসব গ্রাহক ইসলামী ব্যাংকে গেছেন বা যাচ্ছেন তাদের অধিকাংশই সুদকে হারাম মনে করেন বলেই গেছেন।
অবশ্য বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর মনে করেন, ‘মানুষ এখন লাভের চেয়ে আমানত খোয়ানো নিয়ে বেশি চিন্তিত। ফলে বেশি সুদে কেউ পদ্মা ব্যাংকে আমানত রেখে বিপদে পড়তে চান না। মানুষ এখন ভালো প্রতিষ্ঠান বাছাই করে সেখানে আমানত রাখছেন।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, কিছু বিতর্ক থাকলেও সাধারণ ও ছোট গ্রাহকরা ইসলামী ব্যাংকের ওপর আস্থা রাখছেন। সাধারণ মানুষ ব্যাংকটিতে টাকা রাখতে উৎসাহ বোধ করার অন্যতম কারণ, ব্যাংকটিতে বড় কোনও অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের মোট আমানতের ২৫.৭৫ শতাংশই রয়েছে ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর কাছে। এ ছাড়া মোট বিতরণ করা ঋণের ২৮.৩৭ শতাংশও দিয়েছে তারা। প্রবাসী আয়েরও ৪৩.০৬ শতাংশ এসেছে ওই ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে।
অন্যরাও ঝুঁকছে
শুধু গ্রাহকরাই নয়, বেশ কিছু প্রচলিত ধারার ব্যাংকও ইসলামি বিভাগ ও স্কিম চালু করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা দেশে অন্তত সাড়ে ৫ হাজার শাখা-উপশাখায় ইসলামি ব্যাংকিং পরিচালিত হচ্ছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে সরকারি-বেসরকারি মোট ৩৩টি ব্যাংক কোনও না কোনোভাবে ইসলামি ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করেছে।
এর মধ্যে পুরোপুরি ইসলামি ধারায় আছে ১০টি। ব্যাংকগুলো হলো— ইসলামী ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটিজ ইসলামী ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক।
আরও ৯টি ব্যাংক তাদের ৪০টি শাখায় ইসলামি ব্যাংকিং পরিচালনা করছে। এর বাইরেও ১৪টি ব্যাংক তাদের ১৯৪টি শাখায় ‘ইসলামি ব্যাংকিং উইন্ডো’ খুলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য আরও বলছে, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর শেষে দেখা গেছে এজেন্ট আউটলেটসহ ৫ হাজার ১২৩টি ছোটবড় শাখায় ইসলামি ব্যাংকিং এর লেনদেন হচ্ছে। এর মধ্যে সারাদেশে ১ হাজার ৮৫৩ টি পূর্ণাঙ্গ শাখায় এবং ৩ হাজার ২৭০ টি এজেন্ট শাখায় ইসলামি ব্যাংকিংয়ের কার্যক্রম চলছে।
আরও জানা গেছে, গত সাত বছরে ইসলামি ব্যাংকিং সেবা দেওয়ার কেন্দ্র বেড়েছে অন্তত সাড়ে পাঁচগুণ। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯০০টি শাখায় চলেছে ইসলামি ব্যাংকিং। এখন হচ্ছে ৫ হাজার ১২৩টি শাখায়।
পিএসএন/এমআই