আয়ের সাথে কোনোভাবেই ব্যয়কে মিলাতে পারছেন না দেশের সাধারণ মানুষ৷ ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর সুযোগ সন্ধানীদের তৎপরতায় আবার দ্রব্যমূল্য বাড়তে শুরু করেছে৷
নয়না ভৌমিক একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক৷ তার কর্মস্থল ঢাকায়৷ তার স্বামীও ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন৷ পিংকির বেতন ২৭ হাজার টাকা৷ স্বামীর বেতন মিলিয়ে তাদের মোট আয় ৭০ হাজার টাকা৷ পরিবারে মোট সদস্য পাঁচজন৷ ঢাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন৷ পিংকি বলেন, ‘‘বাসাভাড়া, বাচ্চার পড়াশুনা ও খাবারের পিছনে ব্যয় ছাড়াও চিকিৎসা ব্যয়সহ আরো নানা ব্যয় আছে৷ আমাদের দুইজনের আয়েও সংসার চালানো কঠিন৷ প্রতিমাসেই আমাদের ধার করতে হয়৷ ব্যাংক থেকে লোন নিয়েও সামলাতে পারছি না৷ কারণ, কিস্তি দিতে হয়৷ ধারদেনায় ডুবে যাচ্ছি৷’’
তিনি জানান, এবছর তিনি ইনক্রিমেন্ট পেয়েছেন সাতশ’ টাকা৷ তার স্বামী বেসরকারি চাকরি করেন৷ কয়েক বছর ধরে ইনক্রিমেন্ট নরই৷ সাতশ’ টাকা আয় বাড়ার বিপরীতে ব্যয় বেড়েছে অনেক৷ তিনি বলেন, ‘‘এবার শীতকালেও শাক-সবজির দাম কমেনি, উল্টো বেড়েছে৷ সয়াবিন তেল তো লাগামহীন৷’’
তার কথা, ‘‘আমরা দুইজন চাকরি করেও কুলাতে পারছি না৷ যাদের পরিবারে একজন চাকরি করেন, তাদের কী অবস্থা তা আমি নিজের চোখেই দেখতে পারছি৷ দেশের অধিকাংশ মানুষই কষ্টে আছেন৷’’
নাজমুল হক তপন সাংবাদিকতা করেন৷ করোনার প্রভাবে তার বেতন আগের চেয়ে কমেছে৷ এখন বেতন পান ৫০ হাজার টাকা৷ আগে টিভি, রেডিওতে অনুষ্ঠান এবং নানা জায়গায় লিখে বাড়তি আয় হতো৷ সেটাও আর নেই৷ ফলে তিনি পড়েছেন সংকটে৷ তার সন্তানসহ তিনজনের পরিবারে বাজার দরের সাথে আয়ের সামাঞ্জস্য রাখতে ভোগ ও সেবা কমিয়ে ব্যয় কমাতে হয়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘এখন গরুর মাংস কেনা ছেড়েই দিয়েছি৷ মুরগির মাংস কিনছি, তা-ও পরিমাণে কমিয়ে দিয়েছি৷ দুধ আগে কিনতাম মাসে সাত লিটার, এখন কিনি তিন লিটার৷ অফিসে যেতে-আসতে খরচ হতো ১০০ টাকা, এখন হেঁটে অফিসে যাই৷ জীবনের স্বাদ-আহ্লাদ বলতে যা ছিল তা পুরোই বাদ দিয়েছি৷’’
বাজার দরের পাগলা ঘোড়া
মার্চের ৩ তারিখে সয়াবিন ও পাম অয়েলসহ ভোজ্য তেলের দাম লিটারে ১২ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় ভোজ্য তেল ব্যবসায়ীরা৷ সরকার সেই প্রস্তাব নাকচ করে দিলেও ব্যবসায়ীরা ভোজ্য তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন৷ শুধু তাই নয়, বাজারে ভোজ্য তেলের কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হচ্ছে৷ বাজারে এক ও দুই লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয় যাচ্ছে না৷ দেশে পর্যাপ্ত সয়াবিন ও পাম অয়েল থাকলেও একটি সংঘবদ্ধ চক্র এই কাজ করছে৷ এদিকে এলপিজির দাম সরকার প্রতি সিলিন্ডারে ১৫১ টাকা বাড়ালেও বাজারে বেড়েছে আরো বেশি৷ বাজারের ওপরে যেন কারো নিয়ন্ত্রণই নেই৷
চার বছরে যে কয়েকটি ভোগ্যপণ্যের দাম সবচেয়ে বশি বেড়েছে তার মধ্যে সবার ওপরে আছে সয়াবিন ও পামঅয়েল৷ ২০১৯ সালে দেশের বাজারে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম ছিল ১০৪ টাকা৷ ২০২২ সালে ১৭০ টাকা৷ পামঅয়েলের লিটার (খোলা) ২০১৯ সালে ছিল ৫৮ টাকা৷ ২০২২ সালে হয়েছে ১৫০ টাকা৷
আরো কয়েকটি ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির চিত্রের দিকে তাকালে দেখা যায়, দেশের মানুষের প্রধান খাদ্য চালের দামও বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে৷ পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ সালে চিকন চালের কেজি ছিল ৫৩ টাকা, ২০২২ সালে ৭৫ টাকা৷ প্রতি কেজি মোটা চালের দাম ২০১৯ সালে ছিল ৩৪ টাকা, ২০২২ সালে ৫২ টাকা৷ ২০১৯ সালে প্যাকেটজাত আটার কেজি ছিল ৩২ টাকা, ২০২২ সালে হয়েছে ৫২ টাকা৷
আরেক নিত্যপণ্য চিনির দাম তো গত চার বছরে বেড়ে প্রায় দ্বিগুন হয়ে গেছে৷
মুরগি এবং মাংসের বাজারও বেজায় বেসামাল হয়েছে গত চার বছরে৷ বাজারে এখন সবেচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া সোনালি মুরগির কেজি ২০১৯ সালে ছিল ২২০ টাকা, ২০২২ সালে হয়েছে ৩০০ টাকা৷ গরুর মাংসের কেজি ২০১৯ সালে ছিল ৫৪০ টাকা, এখন বিক্রি হচ্ছে ৬৫০ টাকায়৷ এসব পণ্যের বাইরে মশুর ডাল, আদা, রসুন, লবণ, সব ধরনের মসলা, সব ধরনের মাছ এবং সব ধরনের সবজির দামও বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে৷
মূল্যের চাপ সামলানো দায়
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর হিসেবে ২০২০ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬.৮৮ শতাংশ৷ ২০১৯ সালে বেড়েছিল ৬.৫০ শতাংশ আর ২০১৮ সালে ৬ শতাংশ৷ ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় সবচেয়ে বেশি বেড়েছে এই সময়ে৷
আর এখন মুদ্রাস্ফীতি ১০ ভাগেরও বেশি৷ এরসঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাত৷ যে যার মতো দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে যুদ্ধের অজুহাতে৷
ক্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসেন বলেন, ‘‘গত বছরের (২০২১) জীবন যাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির হিসাব আমরা করছি৷ তাতে শতকরা ১০ ভাগের বেশি হবে৷ আর এই বছরে যা শুরু হয়েছে তাতে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় বলা যায় না৷ কিন্তু সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি৷ বরং অনেকের কমেছে৷ মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি দিয়ে হিসাব করলে চলবে না৷’’
তিনি বলেন, ‘‘বাজারের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ এবং মনিটরিং খুবই দুর্বল৷ একটি গোষ্ঠী এখন যুদ্ধের বাজার তৈরি করে মুনাফা লোটার ধান্দায় আছে৷ তাদের এখনই প্রতিরোধ করতে হবে৷ নয়তো পরিস্থিতি আরো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়বে৷ ভোক্তা অধিকারের দুই-একটি অভিযান দিয়ে কাজ হবে না৷ সরকারকে সর্বাত্মকভাবে ব্যবস্থা নিতে হবে৷’’
গত নভেম্বরে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং পিপিআরসি এক গবেষণায় বলেছে, তিন কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন৷ গত বছরের মার্চে এই সংখ্যা ছিল দুই কোটি ৪৫ লাখ৷ তারপর ছয় মাসে ৭৯ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছেন৷
নাজের হোসেন বলেন, ‘‘আয় যদি বাড়েও তাতে লাভ নেই, কারণ, ব্যয় বাড়ছে তার চেয়ে অনেক বেশি৷ সুতরাং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে৷ তাহলে প্রকৃত আয় বাড়বে৷ নয়তো প্রকৃত আয় কখনোই বাড়বেনা৷ আয় কখনোই ব্যয়ের নাগাল পাবে না৷’’
যুদ্ধের বাজারে করণীয় কী?
অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন ২০২০ সাল থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে৷ বাংলাদেশ চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পরও চালের দাম বেড়েছে অনেক৷ তার কথা, ‘‘আমদানি করা পণ্যের দাম বিশ্ববাজারে বাড়লে এখানেও বাড়বে৷ কিন্তু ব্যবসায়ীদের অনেকে এর অনৈতিক সুযোগ নেন৷ দেশের বাইরে বাড়লে আগে কম দামে আমদানি করার পণ্যের দামও তারা বাড়িয়ে দেন৷’’
তিনি বলেন, ‘‘বড় দেশ যখন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তখন তার প্রভাব সারা বিশ্বেই পড়ে৷ আমাদের এখানেও পড়বে৷ এখনো প্রভাব পড়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি৷ কিন্তু এখনই সুযোগ সন্ধানীরা সক্রিয়৷’’
তার মতে, এর বাইরে করোনার সময়ে শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বেই প্রণোদনা দেয়া হয়েছে৷ করোনা পরবর্তী সময়ে এর প্রভাব পড়ছে বাজারে৷ জিনিসপত্রের দাম সারা বিশ্বেই বাড়ছে৷ কিন্তু বাংলাদেশে যুক্তির বাইরে দাম বাড়ছে৷
এরজন্য বাজার মনিটরিংয়ের সাথে সাথে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা বাড়াতে হবে বলে মনে করেন তিনি৷ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের রেশনিং-এর ব্যবস্থা করতে হবে৷ নিম্নবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত যাতে এটা পায় তা নিশ্চিত করতে হবে৷ সরকাররকে এখনই এর পরিকল্পনা করতে হবে বলে তার অভিমত৷
তিনি বলেন, ‘‘আয় বৈষম্য বেড়েছে৷ দারিদ্র্যসীমার প্রান্তিক লাইনে বিপুল সংখ্যক মানুষ আছে৷ আর নিম্নমধ্যবিত্ত আছে সবচেয়ে কষ্টে৷ কারণ, তারা বলতেও পাবরছে না তাদের দুরবস্থার কথা৷’’
পিএসএন/এমঅাই