ব্যাংকবহির্ভূত কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান এখন মৃতপ্রায়। তারা অনেক দিন ধরে আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। পাচ্ছে না নতুন আমানতও। বিভিন্ন সময়ে দেওয়া ঋণের বড় অংশ অনাদায়ী হয়ে গেছে। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হিসাবে দেশের মোট ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১১টির বিতরণ করা ঋণের ৭৫ থেকে ৯৯ শতাংশ খেলাপি। এর মধ্যে পাঁচ প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ৯৫ শতাংশের বেশি। আর মোট ঋণের অর্ধেক বা এর বেশি খেলাপি ২২ প্রতিষ্ঠানের। সব মিলিয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মোট ঋণের প্রায় ৩৬ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে এমন দুরবস্থার চিত্র পাওয়া গেছে।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এফএএস ফাইন্যান্সের ১ হাজার ৮২২ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ১ হাজার ৮২০ কোটি টাকাই এখন খেলাপি। এর মানে প্রতিষ্ঠানটির ৯৯ দশমিক ৯২ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। একইভাবে ফারইস্ট ফাইন্যান্সের ৮৯০ কোটি টাকা ঋণের ৯৮ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। বিআইএফসির ৭৭৩ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ৯৭ দশমিক ২৭ শতাংশ। পিপলস লিজিংয়ের ১ হাজার ৫৮ কোটি টাকা ঋণের ৯৭ শতাংশ এখন খেলাপি। ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের ৪ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৯৬ দশমিক ১৯ শতাংশ অর্থাৎ ৩ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। ইউনিয়ন ক্যাপিটালের ১ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা ঋণের ৯৪ দশমিক ৬০ শতাংশ এখন খেলাপি।
আভিভা ফাইন্যান্সের ২ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা ঋণের ৮৯ দশমিক ৮১ শতাংশ খেলাপি। ফিনিক্স ফাইন্যান্সের খেলাপি ঋণ ৮৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ফার্স্ট ফাইন্যান্স ৮৭ দশমিক ৮২ শতাংশ, প্রাইম ফাইন্যান্স ৭৭ দশমিক ৬২ এবং প্রিমিয়ার লিজিংয়ের ৭৫ দশমিক ২০ শতাংশ এখন খেলাপি।
মোট ঋণের অর্ধেক বা এর বেশি খেলাপির তালিকায় থাকা আইআইডিএফসির ৬৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। বে লিজিংয়ের ৬৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ, ন্যাশনাল ফাইন্যান্সের ৬৩ দশমিক শূন্য ৩, সিভিসি ফাইন্যান্সের ৫৯ দশমিক ৫৪, জিএসপি ফাইন্যান্সের ৫৮ দশমিক ২৪, মেরিডিয়ান ফাইন্যান্সের ৫৭ দশমিক ৬৯ এবং উত্তরা ফাইন্যান্স ৫৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, এসব প্রতিষ্ঠানের নিট আয় বলতে কিছু নেই। তারা ঋণ থেকে যা আদায় হচ্ছে, তা দিয়ে কোনো মতো বেতনভাতা দিয়ে টিকে আছে। তারা আমানত ভেঙে খাচ্ছে। তিনি মনে করেন, বিভিন্ন পক্ষের যোগসাজশে চরম অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের এই দুরবস্থা। দ্রুত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৩টির মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যাদের খেলাপি ঋণ তুলনামূলক কম। যে কারণে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সার্বিকভাবে এ খাতের ৭৩ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ২৬ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা। মোট ঋণের যা ৩৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। তিন মাস আগে গত জুন শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২৪ হাজার ৭১১ কোটি টাকা। আর গত বছরের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২১ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা, যা ওই সময় পর্যন্ত বিতরণ করা ঋণের ২৯ দশমিক ২৭ শতাংশ। এর মানে শেষ তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। আর ৯ মাসে বেড়েছে ৪ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এখন উচ্চ সুদ দিয়েও আমানত পাচ্ছে না। গত নভেম্বর মাসে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে ১০ দশমিক ৪৩ শতাংশ সুদে আমানত নিয়েছে। আর ঋণের গড় সুদহার ছিল ১৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এরপরও আশানুরূপ আমানত পাচ্ছে না। ফলে নতুন ঋণ বিতরণও তেমন হচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগই কোনো মতো টিকে আছে। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানের আমানতের পরিমাণ কমে ৪৭ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকায় নেমেছে। গত জুন শেষে যা ছিল ৪৭ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা। আর গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ছিল ৪৭ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। একইভাবে ঋণস্থিতি কমে গত সেপ্টেম্বর শেষে ৭৩ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকায় নেমেছে। তিন মাস আগে ছিল ৭৪ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা। আর গত ডিসেম্বর শেষে ছিল ৭৩ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি ত্রৈমাসিকের সুদ যোগ করে আমানত ও ঋণ স্থিতির হিসাব হয়। ফলে নিট ঋণ ও আমানত কমেছে অনেক বেশি।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের দুরবস্থার কারণ জানতে চাইলে বিশিষ্ট ব্যাংকার ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নূরুল আমিন সমকালকে বলেন, ব্যাংকের পর আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ার ভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল। তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও ব্যাংকের মতোই পণ্য নিয়ে একই গ্রাহকের পেছনে ছুটেছে। তবে ব্যাংকের দক্ষতা ও সক্ষমতা এসব প্রতিষ্ঠানের নেই বলে পিছিয়ে পড়েছে। আবার বাংলাদেশে এত ব্যাংকের পর আবার ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আদৌ প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা পর্যালোচনা করা হয়নি। রাজনৈতিক বিবেচনায় কিছুদিন আগেও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তার সুপারিশ হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য ৫ থেকে ৬ হাজার কোটি টাকা দিয়ে একটি ব্যবস্থা করুক।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে চরম বিশৃঙ্খলা থাকলেও দীর্ঘদিন তা আড়ালে ছিল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মালিকানায় যুক্ত পক্ষগুলোর ভাগবাটোয়ারার অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায় এসব প্রতিষ্ঠান। ২০১৯ সালে এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা গ্লোবাল ইসলামী ও আভিভা ফাইন্যান্সের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার হালদার ভুয়া কোম্পানি খুলে এফএএস ফাইন্যান্স, বিআইএফসি, পিপলস লিজিং ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং নিয়ন্ত্রণে নেয়। এক পর্যায়ে এসব প্রতিষ্ঠান আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে পারছিল না। যে কারণে পিপলস লিজিং, বিআইএফসিসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অবসায়নের উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও তা কার্যকর হয়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতো ব্যাংক খাতেও খেলাপি ঋণ বেড়েছে। চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা বা ৯ শতাংশ ছিল খেলাপি। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বিভিন্ন অনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নেওয়া ঋণ খেলাপি হতে শুরু করায় এভাবে খেলাপি ঋণ বাড়ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। আইএমএফ ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমানোর শর্ত দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে মোট ঋণের ৫ শতাংশ এবং সরকারি ব্যাংকের ১০ শতাংশের নিচে নামাতে বলা হয়েছে।