সাকিবুর রহমান
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে ঐতিহাসিক জুলাই বিপ্লবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পতনের পর আপাত দেশের দায়িত্ব এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে। বিগত ১৫ বছরের দুঃশাসনে রাষ্ট্রযন্ত্র তথা নির্বাচনী ব্যবস্থায় ভয়াবহরকমের ধস নামে। পুরোপুরি দলীকরণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেকটি মারা হয়। কিন্তু ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নির্বাচন ব্যবস্থাসহ রাষ্ট্র ব্যবস্থা সংস্কারে বিভিন্ন কমিশন গঠন করা হয়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের প্রশ্নে অনেক রাজনৈতিক দল আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন বা পিআর পদ্ধতিতে ভোটের দাবিও তুলছেন।
আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা কী?
সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে নির্বাচনে আসনভিত্তিক কোনো প্রার্থী থাকে না। ভোটাররা দলীয় মনোনীত প্রার্থীর বদলে প্রতীকে ভোট দেবেন। একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সেই অনুপাতেই সংসদের আসন সংখ্যা বণ্টন হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি কোন দল মোট প্রদত্ত ভোটের শতকরা ১০ শতাংশ পায়, তাহলে সেই দল আনুপাতিক হারে সংসদের ১০ শতাংশ বা ৩০টি আসন পাবেন।
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে মূলত বিভিন্ন দেশে তিনটি পদ্ধতিতে নির্বাচন সম্পন্ন হয়- মুক্ত তালিকা, বদ্ধ তালিকা ও মিশ্র পদ্ধতি।
মুক্ত তালিকায় নির্বাচন কমিশন ঘোষিত সময়ের মধ্যে দলগুলো প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে। ফল প্রকাশের পর প্রাপ্ত ভোটের হার অনুযায়ী আনুপাতিক হারে তালিকার ক্রমানুযায়ী আসন বণ্টন হয়। বদ্ধ পদ্ধতিতে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হয় না। আর মিশ্র পদ্ধতিতে কিছু আসনে সমানুপাতিক ও কিছু আসনে আসনভিত্তিক নির্বাচন হয়। আবার কোনো কোনো দেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের প্রচলন রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোথাও এক কক্ষে সমানুপাতিক আবার অন্য কক্ষে আসনভিত্তিক নির্বাচন হয়।
প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থার সাথে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির পার্থক্য যেখানে
দেশের বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, জাতীয় সংসদ গঠিত হয় ৩৫০ জন সদস্য নিয়ে। এর মধ্যে ৩০০ জন নির্বাচিত হন একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাগুলো থেকে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে। আর নারীদের জন্য সংরক্ষিত ৫০টি আসনে নির্বাচন হয় দল বা জোটগুলোর পাওয়া আসনের সংখ্যানুপাতে।
একক নির্বাচনী এলাকা হলো সংসদীয় আসন। এখন দেশে নির্বাচন হয় সংসদীয় আসনভিত্তিক, এটি এফপিটিপি হিসেবে পরিচিত। এই পদ্ধতিতে একটি সংসদীয় আসনে প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বেশি ভোট পান, তিনি নির্বাচিত হন। এখানে ভোটের হার বা সারা দেশে কোন দল কত ভোট পেল, তা কোনো বিষয় নয়। কত আসন পেল, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া বিদ্যমান আইনে প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থী না থাকলে একক প্রার্থীকে ভোট ছাড়াই বিজয়ী ঘোষণা করা যায়।
বর্তমান বিশ্বে দুই ধরনের নির্বাচনপদ্ধতি বেশি প্রচলিত। একটি হলো সংসদীয় আসনভিত্তিক ‘র্ফাস্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ বা এফপিটিপি এবং অন্যটি আনুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা অর্থাৎ ‘প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন’ বা পিআর নামে পরিচিত।
রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান
‘আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে ভোট চায় বিএনপি ছাড়া বিভিন্ন দল’- প্রথম আলো (১২ অক্টোবর ২০২৪)
দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আনুপাতিক পদ্ধতি চালু করার দাবি নতুন কিছু নয়। কিছু রাজনৈতিক দল অনেক দিন ধরেই এই দাবি জানিয়ে আসছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০১৭ সালে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছিল নির্বাচন কমিশন। সেই আলোচনায় জাতীয় পার্টি, সিপিবি, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলসহ (বাসদ) কিছু দল এই পদ্ধতিতে নির্বাচন করার প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে ওয়ার্কার্স পার্টি বিদ্যমান পদ্ধতির পাশাপাশি আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের বিধান করা অর্থাৎ মিশ্র পদ্ধতি চালুর প্রস্তাব দিয়েছিল।
সর্বশেষ গত ১২ অক্টোবর ঢাকায় এক সেমিনারে বিএনপি ছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে নির্বাচন করার পক্ষে মত দিয়েছেন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কতটা বাস্তবমুখী পিআর?
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু আছে।
বিশ্বের ১৭০টি দেশের মধ্যে ৯১টি দেশে এই পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যবস্থা চালু রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশ, ইউরোপসহ উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে আনুপাতিক পদ্ধতিতে ভোট অনুষ্ঠিত হয়।
সর্বস্থরের জনগণ তথা সব ভোটারদের মতামতের প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব এই পদ্ধতিতে ভোটের মাধ্যমে, তবুও বিএনপি কেন এই পদ্ধতির বিপক্ষে? বাংলাদেশের রাজনীতিতে সব সময় দলের চেয়ে ব্যক্তিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। যে কারণে এখানে পিআরের মতো দলীয় ‘ইমেজ’ তৈরীর মনোভাব বিএনপি ঠিক নিতে চাইছে না। কিন্তু আধুনিক বিশ্বে স্বৈরাচারী মনোভাব রোধ করতে আনুপাতিক পদ্ধতির নির্বাচনের বিকল্প নেই।
বিএনপির মতো এমন বড় একটি রাজনৈতিক দলের আপত্তিতে এই পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব কী না সেটি নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে।
এই প্রশ্নে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত হচ্ছে, সব দল রাজি হলে এরকম একটি ব্যবস্থার ব্যপারে কার্যকরী উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।
এই পদ্ধতিতে নির্বাচন করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। এ ছাড়া আরও কিছু জটিলতাও আছে। রাজনৈতিক মতৈক্য তৈরি করে শিগগিরই এই পদ্ধতির প্রচলন করা কঠিন হতে পারে।
সত্যিকার সংস্কারে চাই পরিবর্তন
এটি যেহেতু নির্বাচন কমিশনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের এখতিয়ারে নেই। এটি সংবিধানের বিষয়। সংবিধান সংশোধন করে অচিরেই আনুপাতিক নির্বাচনী পদ্ধতির প্রয়োগের সম্ভাবনা কম হলেও অসম্ভব নয় মোটেও। সব দলের উচিৎ পরিবর্তনের মনোভাব নিয়ে সম্মত হওয়া। স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও সংসদীয় পদ্ধতির নির্বাচনে দেশের কোনো নির্বাচনই বিতর্কবিহীনভাবে অনুষ্ঠিত হয়নি। এ থেকেই অনুমান করা যায় নির্বাচনের পদ্ধতির পরিবর্তন না করলে দেশের সত্যিকার সংস্কার মরীচিকাই থেকে যাবে।