দেশের উচ্চ ও অধস্তন আদালতে মামলাজট বেড়েই চলেছে। ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক্করণের সময় মামলা ছিল ১৫ লাখ ৭০ হাজার, যা এখন ৪৪ লাখ ছাড়িয়েছে। এই জট নিরসনে দেড় দশকে বিচার-সংশ্লিষ্ট কিছু আইন সংশোধনের সুপারিশ করা হলেও সরকারের উদাসীনতায় তার অধিকাংশই বাস্তবায়ন হয়নি। এদিকে, মামলার তুলনায় বিচারকের সংখ্যা অপ্রতুল। এমন পরিস্থিতিতে দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে।
গত আওয়ামী লীগ সরকার ও বিচার বিভাগের কিছু উদ্যোগের কারণে আদালতে মামলা নিষ্পত্তির হার বাড়লেও তা যথেষ্ট ছিল না। মামলা দায়েরের তুলনায় সেই হার ছিল কম। ভূমি-সংক্রান্ত কিছু মামলা দুই-তিন দশক ধরে আদালতে বিচারাধীন। ফৌজদারি মামলার সংখ্যাও বাড়ছে। তবে এর মধ্যে রাজনৈতিক মামলা বেশি।
মামলাজট নিরসনে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা (এডিআর) কার্যকরের ওপর গুরুত্বারোপ করে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘বিচারপ্রার্থীরা স্বল্প খরচে অল্প সময়ে মামলা নিষ্পত্তি চান। অথচ শত বছরের পুরোনো আইন দিয়ে নানা অসুবিধার মধ্যে বিচারকাজ চলছে। পুরোনো আইনগুলো সংশোধন করে যুগোপযোগী করা প্রয়োজন। সংশোধিত আইনে এডিআর ব্যবস্থা যুক্ত করতে হবে। যেসব মামলা বাদী-বিবাদীদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যায়, সেগুলো এডিআরের আওতায় নিষ্পত্তি করতে হবে।’
কোন আদালতে ঝুলছে কত মামলা?
সুপ্রিম কোর্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলা ছিল ১২ হাজার ৭৯২টি। গত জুনে তা ২৭ হাজার ৪৭৭টিতে পৌঁছে। এর মধ্যে দেওয়ানি মামলা ১৬ হাজার ৯৯৫টি, ফৌজদারি ১০ হাজার ২৮৬ ও অন্যান্য ১৯৬টি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত সাড়ে ৯ বছরে আপিল বিভাগে মামলা বেড়েছে ১৪ হাজার ৬৮৫টি।
অন্যদিকে হাইকোর্টে গত জুন পর্যন্ত বিচারাধীন মামলা ছিল ৫ লাখ ৬৫ হাজার ৬১৯টি। এর মধ্যে দেওয়ানি ৯৬ হাজার ৬৫৫ ও ফৌজদারি ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৮৩টি। রিট ছিল ১ লাখ ৯ হাজার ৬৪৪ ও আদিম মামলা (অন্যান্য) ২০ হাজার ৩৭টি। আর ২০১৫ সালে হাইকোর্টে বিচারাধীন মামলা ছিল ৩ লাখ ৯৯ হাজার ৩০৩টি, অর্থাৎ সাড়ে ৯ বছরে হাইকোর্টে মামলা বেড়েছে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৩১৬টি।
২০১৫ সালে অধস্তন আদালতের জেলা ও দায়রা জজসহ সব ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলা ছিল ২৬ লাখ ৯৭ হাজার ৮৭২টি। গত জুনে এই সংখ্যা ৩৭ লাখ ৮৭ হাজার ৮৬৬টিতে পৌঁছে। এর মধ্যে দেওয়ানি মামলা ১৫ লাখ ৯৫ হাজার ২০০ এবং ফৌজদারি ২১ লাখ ৯২ হাজার ৬৬টি। অর্থাৎ সাড়ে ৯ বছরে অধস্তন আদালতে মামলা বেড়েছে ১০ লাখ ৮৯ হাজার ৮৭২টি।
অগ্রগতি সামান্য
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতিবছর গড়ে সোয়া লাখ মামলার জট তৈরি হচ্ছে। বিচারকের সংখ্যা সামান্য বাড়ার কারণে মামলা নিষ্পত্তি এক দশকে কিছুটা বেড়েছে। তবে এই হার মামলা দায়েরের তুলনায় কম।২০১৬ সালে মামলাজট কিছুটা কমতে শুরু করে। ওই বছর দেশের সব আদালতে মামলা দায়ের হয় ৩ লাখ ৭৬ হাজার ৮২০টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয় ৩ লাখ ৫১ হাজার ৫৬৪টি। এর পরও ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে ৪৬ হাজার ৯১১টি মামলার জট তৈরি হয়।
অবশ্য ২০২২ সালে মামলা দায়েরের চেয়ে নিষ্পত্তি ছিল বেশি। ওই বছর আদালতে বিচারাধীন মামলা ছিল ৪১ লাখ ৯৬ হাজার ৬০৩টি। আগের বছর সংখ্যাটি ছিল ৪২ লাখ ৩ হাজার ৫১৬। অর্থাৎ ২০২২ সালে দায়েরের চেয়ে ৬ হাজার ৯১৩টি মামলা বেশি নিষ্পত্তি হয়।
জট নিরসনের উপায় কী
দেশে বিদ্যমান ফৌজদারি ও দেওয়ানি বিচার ব্যবস্থা শত বছরের পুরোনো। দেওয়ানি কার্যবিধির বয়স ১১৬ বছর, ফৌজদারির ১২৬ বছর। সাক্ষ্য আইনের বয়স ১৫২ বছর। আইনজীবীরা বলছেন, পুরোনো এই বিচার ব্যবস্থা বর্তমান প্রেক্ষাপটে দ্রুত বিচার নিশ্চিতের ক্ষেত্রে অন্তরায়। বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত করতে হলে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি শতাব্দীপ্রাচীন আইন সংস্কার ও নতুন আইন করা প্রয়োজন। ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের কিছু ধারা সংশোধন করাও জরুরি।
অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ এস এম রেজাউল করিম এ বিষয়ে সমকালকে বলেন, ‘মামলাজট নিরসনে পাঁচটি পক্ষকে, অর্থাৎ বিচারক, দুই পক্ষের আইনজীবী ও মামলার বাদী-বিবাদীকে আন্তরিক হতে হবে।’ তাঁর মতে, মামলাজটের জন্য সরকার ও পুলিশের দায় আছে। সরকারের দায় আছে, কারণ পুরোনো আইনে বিচার চলছে। তিনি বলেন, ‘মামলা অনুপাতে পর্যাপ্ত বিচারক নিয়োগ জরুরি। তা ছাড়া আইনে সাক্ষীদের যাতায়াত খরচ দেওয়ার কথা বলা থাকলেও তা দেওয়া হচ্ছে না।’
পুলিশের দায় প্রসঙ্গে রেজাউল করিম বলেন, ‘দেওয়ানি মামলায় সাক্ষীকে বাদী-বিবাদী নিজ তাগিদে আদালতে আনেন। কিন্তু ফৌজদারি মামলায় সাক্ষী পাওয়া যায় না। কারণ ঘটনার প্রায় চার-পাঁচ বছর পর পুলিশ চার্জশিট দেয়। তখন সাক্ষীকে আদালতে হাজির করতে চাইলে দেখা যায়, তারা স্থান পরিবর্তন করেছেন। আবার সাক্ষী আদালতে এলেও অনেক সময় ঘটনা সম্পর্কে স্মৃতি তেমন উজ্জ্বল থাকে না। ফলে সাক্ষী এলোমেলো কথা বলেন। এতে আসামি খালাস পায় বা সাজা কম হয়।’ এসব বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে মামলাজট চলতেই থাকবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আইন কমিশনের সুপারিশ
মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি ও জট কমিয়ে আনার বিষয়ে গত বছরের আগস্টে আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে প্রতিবেদন দাখিল করে আইন কমিশন। প্রতিবেদনে মামলাজটের পাঁচটি মূল কারণ উল্লেখ করা হয়। এগুলো হলো– পর্যাপ্ত বিচারক না থাকা, বিশেষায়িত আদালতে পর্যাপ্ত বিচারক নিয়োগ না হওয়া, মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা, জনবলের অভাব এবং দুর্বল অবকাঠামো। এ ছাড়া প্রতিবেদনে জরুরি ভিত্তিতে বিভিন্ন পর্যায়ে চার বছরে কমপক্ষে পাঁচ হাজার বিচারক নিয়োগ এবং আদালতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য সুপারিশ করা হয়। ২০১২ সালেও মামলাজট নিরসনে ফৌজদারি আইন ও দণ্ডবিধিসহ পুরোনো আইনগুলো সংশোধন, পর্যাপ্ত বিচারক নিয়োগের সুপারিশ করে এই কমিশন। তবে অধিকাংশ সুপারিশই বাস্তবায়ন হয়নি।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, ‘বিগত সরকারগুলোর উদ্দেশ্যই ছিল আইনি মারপ্যাঁচে যতটা সম্ভব রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়া। যদি এটি না হতো, তাহলে বিচার ব্যবস্থা অবশ্যই ফাংশনাল হতো।’ তিনি আরও বলেন, ‘পুরোনো আইন সংশোধন ও পর্যাপ্ত বিচারক নিয়োগ না হওয়ার দায় সরকারকেই নিতে হবে। সরকারকে ঠিক করতে হবে, দক্ষ ও যোগ্য বিচারক নিয়োগের উপায় কী, বিচার বিভাগ কীভাবে সংস্কার হবে। এগুলো না হওয়ার কারণেই মামলাজট প্রকট হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে ৫০ বছরেও মামলাজট থেকে রেহাই মিলবে না।’
অবিলম্বে লঘু অপরাধে দায়ের হওয়া ফৌজদারি মামলা, পারিবারিক বিরোধের মামলা এবং ছোটখাটো দেওয়ানি মামলার তালিকা করে আদালতের বাইরে দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।এ বিষয়ে আইন সচিব (চলতি দায়িত্ব) শেখ আবু তাহের সমকালকে বলেন, ‘বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বিচার বিভাগ সংস্কারে কমিশন গঠন করেছে। আশা করছি, কমিশনের রিপোর্টে মামলাজট নিরসনের বিষয়ে সুপারিশ থাকবে। মন্ত্রণালয় সুপারিশ পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।’