যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং তার সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাই জারি করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)। একই আদেশ জারি করেন ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের নেতা মোহাম্মদ দেইফের বিরুদ্ধেও।
গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনের মধ্যে এই প্রথম আন্তর্জাতিক আদালত নেতানিয়াহু বা কোনো ইসরায়েলি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করলেন।
বৃহস্পতিবার আইসিসি এক বিবৃতিতে জানান, ইসরায়েলে গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলা এবং এর জের ধরে গাজায় দেশটির গণহত্যামূলক যুদ্ধ শুরুর ঘটনায় নেতানিয়াহু, গ্যালান্ট ও হামাসের নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে মোহাম্মদ দেইফকে গত জুলাইয়ে হত্যা করার দাবি করে ইসরায়েল। তবে তিনি বেঁচে আছেন কি না, সেটি স্পষ্ট নয়।
এই তিনজন এখন থেকে আন্তর্জাতিকভাবে তালিকাভুক্ত গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আসামি বলে গণ্য হবেন এবং তাদের গ্রেপ্তার করতে আইসিসিভুক্ত দেশগুলোর আইনি বাধ্যবাধকতা থাকবে। তবে আইসিসির এমর আদেশকে ‘ইহুদিবিদ্বেষী’ বলে নিন্দা জানিয়েছেন ইসরায়েলি কর্মকর্তারা।
নেতানিয়াহু ও গ্যালান্টের বিরুদ্ধে অভিযোগে আইসিসি বলেন, অন্তত গত বছরের ৮ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ২০ মে পর্যন্ত মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে নেতানিয়াহু ও গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন তারা। এ অভিযোগের সঙ্গে গাজার বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে ক্ষুধাকে ব্যবহার করা ও স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট স্থাপনাকে ইচ্ছাকৃতভাবে নিশানা বানানোর বিষয়টিও যুক্ত রয়েছে।
আইসিসির প্রধান কৌঁসুলি করিম খান প্রথম গত মে মাসে নেতানিয়াহু ও গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে আন্তর্জাতিক আদালতের কাছে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। আদালত বলছেন, গাজাবাসীকে গণহারে ক্ষুধায় রাখার পেছনে নেতানিয়াহুর ‘অপরাধমূলক দায়’ থাকার গ্রহণযোগ্য ভিত্তি রয়েছে।
নেতানিয়াহু ও গ্যালান্ট—দু’জনকেই গাজায় ‘ক্ষুধাকে যুদ্ধাস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করায় অভিযুক্ত করেছেন আদালত। এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মূলত আদালত গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত উপত্যকাটিতে খাদ্যসামগ্রী ও মানবিক ত্রাণ সরবরাহে পদ্ধতিগত উপায়ে বাধা দিয়ে চলার ঘটনাকে বুঝিয়েছেন। এর বাইরে আদালত তাদেরকে ‘হত্যা, নির্যাতন ও অন্যান্য অমানবিক কর্মকাণ্ডে’ যুক্ত থাকায় অভিযুক্ত করেন।
কী ঘটতে পারে তাদের ভাগ্যে
নেতানিয়াহু ও গ্যালান্টের বিরুদ্ধে আইসিসির ওই পরোয়ানা জারি করার অর্থ হলো- গ্রেপ্তার হলে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে। তবে যতক্ষণ গ্রেপ্তার না হচ্ছেন, ততক্ষণ বিচার শুরু হচ্ছে না। কেননা, নেতানিয়াহু ও গ্যালান্টের অনুপস্থিতিতে তাদের বিচার করার এখতিয়ার আইসিসির নেই।
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবাধিকার আইনের অধ্যাপক ও ব্রিটিশ সোসাইটি ফর মিডল ইস্ট স্টাডিজের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক নেভ গর্ডন আল–জাজিরাকে বলেন, আইসিসির কাছে এটি একটি জোরালো মামলা এবং ক্ষুধাকে গাজাবাসীর বিরুদ্ধে ইসরায়েলি নেতাদের অস্ত্র বানানোর বিষয়টি প্রমাণ করা সহজ হবে।
নেভ গর্ডন বলেন, ‘প্রায় ২০ বছর ধরে ইসরায়েল ক্ষুধাকে গাজায় অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। আমি মনে করি, ইসরায়েলের নেতাদের বক্তব্য ও দেশটির সামরিক বাহিনীর কর্মকাণ্ডে খাদ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার অভিপ্রায় স্পষ্ট।’
এ ছাড়া গাজার ৩৬টি হাসপাতালের সবগুলো ইসরায়েলি বাহিনী নিশানা করেছে বলে উল্লেখ করেন এই অধ্যাপক। আল–জাজিরার তথ্য অনুযায়ী, উপত্যকাটিতে প্রায় বিরামহীনভাবে চালানো বোমা হামলায় অ্যাম্বুলেন্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদেরও নিশানা করা হয়েছে। গর্ডন বলেন, এসব প্রমাণ আইসিসির প্রসিকিউটরদের মামলা পরিচালনায় সহায়তা করবে।
পরোয়ানার ফলাফল কেমন হবে
আদালতের এ পরোয়ানার ফলাফল বাস্তবে দেখা যেতে পারে। গতকালের আগে নেতানিয়াহু ও গ্যালান্ট যেভাবে বিদেশে ভ্রমণ করেছেন, এখন থেকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এমন সফর করাটা তাদের জন্য কঠিন হয়ে উঠবে। কেননা বিদেশ সফরে গিয়ে গ্রেপ্তার হতে পারেন তারা।
নেতানিয়াহু ও গ্যালান্টের গ্রেপ্তার হওয়ার এমন সম্ভাবনা থাকার কারণ, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রোম সনদে ১২৪টি দেশ স্বাক্ষর করেছে। এসব দেশে সফরে গেলে তাদের গ্রেপ্তার করতে সংশ্লিষ্ট সরকারগুলোর আইনি বাধ্যবাধকতা থাকবে।
অবশ্য এ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রে কার্যকর হবে না। দুটি দেশই এ আদালতের সদস্য না হওয়ায় পরোয়ানা মানতে বাধ্য নয়। বাস্তবেও নেতানিয়াহু ও গ্যালান্ট যুক্তরাষ্ট্র সফর করলে তাঁদের ওই আদালতের কাছে সম্ভবত তুলে দেবে না দেশটি।
এর বাইরে পরোয়ানা কার্যকর করার নিজস্ব ক্ষমতা আইসিসির নেই। আবার পুলিশি শক্তিতেও ঘাটতি রয়েছে এ আদালতের। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আদালত ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালানোর ঘটনায় গত বছরের মার্চে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। কিন্তু পুতিন এখনো গ্রেপ্তার হননি, বরং বহাল তবিয়তে আছেন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, পশ্চিমা দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের মতো ইউরোপের দেশগুলোতে আইসিসির এ সিদ্ধান্তের সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। ইসরায়েলে অস্ত্রশস্ত্রের জোগান দিয়ে থাকে এসব দেশ।
গর্ডন আল–জাজিরাকে বলেন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর এক সুনির্দিষ্ট চাপ তৈরি করেছেন আইসিসি। ইসরায়েলি নেতারা যদি মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হন, সেক্ষেত্রে এর অর্থ, দেশগুলো ইসরায়েলকে যে অস্ত্র দিচ্ছে, তা অব্যাহত রাখা হবে অপরাধের কাজ। এসব দেশকে ইসরায়েলের সঙ্গে করা বাণিজ্য চুক্তিগুলো অবশ্যই পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে।