মিষ্টি খাবার খেতে সবারই ভালোলাগে। তবে অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
অনুষ্ঠানে, উৎসবে কিংবা কোনো সাফল্য উদযাপনে মাঝে মধ্যে মিষ্টি খাবার খাওয়া যেতেই পারে। তাই বলে প্রতিদিন চিনি খাওয়া ঠিক না।
‘দি আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন’য়ের নির্দেশনা অনুসারে একজন সুস্থ সবল প্রাপ্ত বয়স্ক নারীকে দৈনিক ছয় চা-চামচ বা ২৫ গ্রামের মধ্যে চিনি গ্রহণের পরিমাণ সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। পুরুষদের ক্ষেত্রে এই পরিমাপ হবে ৩৭.৫ গ্রাম বা নয় চা-চামচ।
মার্কিন পুষ্টিবিদ অ্যামি গুডসন এই বিষয়ে ইটদিস ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলেন, “মাঝেমধ্যে এই পরিমাণের চাইতে বেশি খেলে তেমন কোনো প্রভাব পড়ে না। তবে প্রতিনিয়ত বেশি পরিমাণে চিনি গ্রহণ করার সাথে দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ, হৃদরোগ, টাইপ টু ডায়াবেটিস হওয়ার পাশাপাশি অন্ত্রের মাইক্রোবায়োম’য়ের মাঝে বিশৃঙ্খলা তৈরির সম্ভাবনা বাড়ে। যা সার্বিকভাবে স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী নয়।”
তাই চিনি খাওয়ার পরিমাণ বেশি হচ্ছে কিনা সেটা বোঝার জন্য কিছু লক্ষণের দিকে নজর দেওয়ার পরামর্শ দেন এই পুষ্টিবিদ।
সবসময় মিষ্টি খেতে ইচ্ছে হওয়া
বেশিরভাগ সময় মিষ্টি খাবার বা পানীয় গ্রহণের ইচ্ছে হওয়ার কারণ হতে পারে অতিরিক্ত মিষ্টি খাওয়ার লক্ষণ।
গুডসন বলেন, “অতিরিক্ত মিষ্টি গ্রহণ করলে মিষ্টি খাওয়ার চাহিদা বাড়ে। কারণ রক্তে দ্রুত শর্করা মিশে আবার কমে যায়।”
এই চক্র তখনই চলতে থাকে, যখন উচ্চমাত্রায় চিনিযুক্ত খাবার খাওয়া হয় তবে হজম ধীর করার জন্য পর্যাপ্ত আঁশ বা প্রোটিন না থাকে। ফলে রক্তে দ্রুত শর্করা মিশে বেড়ে গিয়ে আবার পড়ে যায়।
এই অবস্থা নির্ণয় করা হয় ‘গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (জিআই)’ নির্দেশিকার মাধ্যেমে। যেখানে বলা আছে কোন খাবারের শর্করা কত দ্রুত রক্ত প্রবাহে মেশে।
উচ্চ ‘গ্লাইসেমিক’ খাবারের মধ্যে আছে- ক্যান্ডি, কোমল পানীয়, ডোনাট, মাফিন, কেক ইত্যাদি। অন্যদিকে স্বল্প ‘গ্লাইসেমিক’ খাবার হল- সবজি, পূর্ণ শষ্য ও মটর। এসবে আঁশ বেশি বলে রক্তের শর্করার মাত্রা সহনীয় পর্যায় রাখতে সাহায্য করে।
শক্তির মাত্রা ওঠানামা করা
শক্তির মাত্রা দ্রুত ওঠা-নামা করার একটি কারণ হতে পারে রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত বাড়া-কমার প্রভাবে।
গুডসন বলেন, “মিষ্টি খাবার অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে রক্তের চিনি বা শর্করার মাত্রা লাফ দিয়ে উঠে আবার পড়ে যায় বলে, কোনো সময় অতিরিক্ত সক্রিয় আবার পরক্ষণেই ক্লান্তি ভর করে শরীরে।”
শক্তির এই ওঠা-নামা রোধ করতে সুষম খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন, এই পুষ্টিবিদ।
“উচ্চ আঁশযুক্ত কার্বোহাইড্রেইট যেমন- পূর্ণ শষ্য বা ফল এবং কিছু প্রোটিন ধরনের খাবার মিলিয়ে খাওয়া। প্রোটিন হজম ধীর করে, রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল রাখে”- বলেন গুডসন।
দাঁতে সমস্যা হতে পারে
যদি মুখগহ্বরের স্বাস্থ্য ভালো না থাকে তবে দায়ী হতে পারে চিনি।
গুডসন বলন, “চিনি হল দাঁতের ক্ষয় ও ‘ক্যাভিটি’ হওয়ার প্রধান কারণ। তাই প্রতিনিয়ত দাঁতের সমস্যায় ভোগার লক্ষণ হতে পারে মিষ্টি খাবার বেশি খাওয়া হচ্ছে।”
ওজন বৃদ্ধি
প্রতিনিয়ত মিষ্টি খেলে ওজন বাড়বেই।
“অতিরিক্ত চিনি খেলে বিপাকীয় প্রক্রিয়াতে সমস্যা তৈরি হয় আর অন্ত্রের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। এগুলো রক্তের গ্লুকোজ ও ইন্সুলিন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে”- একই প্রতিবেদনে বলেন মার্কিন পুষ্টিবিদ ও ‘গোওয়েলনেস’য়ের প্রতিষ্ঠাতা কর্টনি ডি’অ্যাঞ্জেলো।
“অন্যভাবে বলা যায়, যত বেশি চিনি খাওয়া হবে ততই শরীরে এর চাহিদা তৈরি হবে।”
পাশাপাশি মিষ্টি খাবারকে প্রায়ই ‘ক্যালরি’হীন খাবার হিসেবে বলা হয়। মানে হল প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান থাকে না।
দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহে ভোগা
গা-হাত পা ব্যথা আর দেহে জড়তা কাজ করার অন্যতম কারণ হতে পারে চিনিযুক্ত খাবার বেশি পরিমাণে খাওয়া। কারণ চিনি একটি প্রদাহযুক্ত খাবার। যা বেশি গ্রহণে দেহে প্রদাহ তৈরি করে।
সবসময় ক্ষুধার্ত বোধ করা
মিষ্টি খাবার বেশিরভাগ সময় খিদা মেটাতে কাজ করে না। তাই খাবার খেয়ে তৃপ্তিবোধ কাজ না করার কারণ হতে পারে মিষ্টিধরনের খাবার বেশি খাওয়া হচ্ছে।
ডি, অ্যাঞ্জেলো বলেন, “সাধারণভাবে মিষ্টি মানে অতিরিক্ত ক্যালরি তবে প্রোটিন, আঁশ এবং স্বাস্থ্যকর চর্বির অনুপস্থিতি। দেহ এই ক্যালরি দ্রুত খরচ করে ফেলে, যে কারণে ক্ষুধা অনুভুত হয় তাড়াতাড়ি। উল্টাপাল্টা খাওয়া পারতপক্ষে ক্ষুধা তেমন মেটাতে পারে না।”
অতিরিক্ত চিনি দেহের ‘লেপটিন’ হরমোনের কাজেও বাধা দেয়। এই হরমোন ক্ষুধা ব্যবস্থাপনায় কাজ করে। লেপটিন’য়ের মাত্রা কমলে সাধারণত বেশি খিদা লাগে আর খাওয়ার ইচ্ছা বৃদ্ধি পায়।
গুডসন বলেন, “দিনের শুরুতে অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার দিয়ে নাস্তা করলে দুপুরের আগেই খিদা লেগে যাবে। তাই সকালে নাস্তায় রাখতে হবে উচ্চ আঁশযুক্ত কার্বোহাইড্রেইট যেমন ওটস বা পূর্ণ শষ্যের তৈরি পাউরুটি সাথে প্রোটিন হিসেবে ডিম বা দই। আঁশ ও প্রোটিন দীর্ঘক্ষণ পেটভরা অনুভূতি দিতে পারে।”
হতে পারে উচ্চ রক্তচাপ
কারও কারও ক্ষেত্রে অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার কারণে রক্তচাপ বৃদ্ধি পেতে পারে।
‘নিউট্রিয়েন্টস’ সাময়িকীতে প্রকাশিত ‘ইউনিভার্সিটি অফ ডেলাওয়ার’য়ের গবেষকদের করা গবেষণায় দেখা গেছে, চিনিযুক্ত খাবার খাওয়ার সাথে রক্তচাপ বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক।
ডি’অ্যাঞ্জেলো বলেন, “যদি লক্ষ্য করেন রক্তচাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে তবে সেটা হতে পারে চিনি অতিরিক্ত খাওয়ার লক্ষণ।”
এছাড়া দেহে ইউরিক অ্যাসিড’য়ের মাত্রাও বাড়ায় অতিরিক্ত চিনি। যা নাইট্রিক অক্সাইড’য়ের উৎপাদন ব্যহত করে।
মার্কিন পুষ্টিবিদ ট্রিস্টাবেস্ট বলেন, “নাইট্রিক অ্যাসিড ধমনী ও শিরা শিথিল রাখতে কাজ করে। এটা ছাড়া রক্তচাপ বাড়তেই পারে।”