২০৩০ সাল নাগাদ দেশে একশোটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে সরকার। যেখানে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ‘মীরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল’। সেখানে প্রত্যাশিত বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও বার্ষিক আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অন্যগুলোর চেয়ে বেশি। প্রথমে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা ছিল মাত্র দেড় লাখ। সেখান থেকে বাড়িয়ে এ প্রকল্পে এখন চার লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীর মাধ্যমে স্থাপন করা হবে রপ্তানিভিত্তিক শিল্প।
প্রকল্পের শুরুতে মীরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে রপ্তানি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১ দশমিক ২৫ বিলিয়ন অর্থাৎ ১২৫ কোটি মার্কিন ডলার। এখন তা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ২৬ হাজার ৯৬৬ কোটি মার্কিন ডলার। রপ্তানি দেড় বিলিয়ন থেকে এখন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩২ হাজার ৩৪০ কোটি মার্কিন ডলার। এই অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকে সরকারের বছরে মাত্র ১ কোটি ৫৮ লাখ মার্কিন ডলার আয়ের পরিকল্পনা ছিল। এখন সেই প্রত্যাশা বেড়ে ২ হাজার ১৬০ কোটি মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (চট্টগ্রাম ইডিজেড) নির্বাহী পরিচালক মশিউদ্দিন বিন মেজবাহ জাগো নিউজকে বলেন, ‘মীরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্লটের চাহিদা ছয় শতাধিক। সেই অনুযায়ী আমরা প্লট দিতে পারছি না। সময় যত গড়াচ্ছে, ততই বাড়ছে প্লটের চাহিদা।’
‘এখানে অর্ধেকের বেশি চাহিদা বিদেশি কোম্পানির কাছ থেকে এসেছে। এজন্য মীরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের পরিধি ও পরিসর বাড়বে। আমরা প্রথমে যে লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিলাম, তা থেকে সব কিছুই বাড়বে। বিদেশি বিনিয়োগসহ এখানে কর্মসংস্থানও বাড়বে। প্রকল্পের কাজ পুরোদমে শুরু হয়েছে। সড়কসহ গুরুত্বপূর্ণ অর্ধেক কাজ এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে।’
চলমান মীরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রকল্পের পরিসর বাড়িয়েই নতুন পরিকল্পনা তৈরি করেছে প্রকল্পটির বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা)। চট্টগ্রামের মীরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্পপ্লটের সংখ্যা ২৫০ থেকে বাড়িয়ে ৫৩৯টি করা হবে। প্রতিটি প্লট হবে তিন হাজার ৬০০ বর্গমিটারের। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য ২৫ দশমিক ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক তৈরি ও ৪৫ একর জমিতে হবে জলাধার।
পরিবেশ সুরক্ষার জন্য একটি সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ও চারটি কেন্দ্রীয় তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য পাইপলাইন স্থাপন করা হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চলে নতুন করে ফায়ার স্টেশনসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি, দুটি কারখানা ভবন, ফুটপাত, গাড়ি মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ, তিনটি আবাসিক ভবন, একটি মসজিদ এবং একটি মেডিকেল সেন্টার নির্মাণসহ কয়েকটি নতুন অঙ্গ সংযোজন করা হবে। মূলত সংশোধনের মাধ্যমে এ অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকে আরও বেশি প্রত্যাশা করছে সরকার।
জানা যায়, প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৫৭ শতাংশ। মাঝপথে এসে অর্থনৈতিক অঞ্চলের পরিধি ও পরিসর বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হলো। মূল প্রকল্পের ব্যয় ছিল ৭৫০ কোটি ৫৮ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। এখন প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে এক হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। মূল অনুমোদিত প্রকল্পটি ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২১ সালের জুন মেয়াদে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা ছিল। এখন প্রকল্পের মেয়াদ বেড়ে ২০২৩ সালের জুন নাগাদ করা হয়েছে।
বেপজা জানিয়েছে, বেপজার আওতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত আটটি ইপিজেডে শিল্পপ্লট ও নিজস্ব কারখানা ভবনের ফ্লোর স্পেস বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ভাড়ায় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ইপিজেডগুলোতে কোনো শিল্পপ্লট খালি নেই। বিনিয়োগের ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম বা চট্টগ্রামের অদূরে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন জরুরি হয়ে পড়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজ শুরু করা হয়।
অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের জন্য এক হাজার ১৫০ একর জমি বরাদ্দের বিষয়ে বেপজা ও বেজার মধ্যে ‘ডেভেলপমেন্ট এগ্রিমেন্ট’ নামে সমঝোতা স্মারকও সই হয়েছে। এর আওতায় ‘অর্থনৈতিক অঞ্চল, মীরসরাই’ প্রকল্প বাস্তবায়নে এক হাজার ১৩৮ একর জমি ৫০ বছরের জন্য লিজ পেয়েছে বেপজা।
‘মীরসরাই বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চল-১’ প্রকল্পে এখন পর্যন্ত ৮১ শিল্পপ্রতিষ্ঠান ৬৪৩টি শিল্পপ্লটের চাহিদার কথা জানিয়েছে। এ পর্যন্ত ৫৮৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব পাওয়া গেছে। প্রস্তাবিত কর্মসংস্থান এক লাখ ২০ হাজার ২৯৩ জন। প্রথম পর্যায়ে ২৫০টি শিল্পপ্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে প্রয়োজনীয় মাটি ভরাট কাজ শেষ হয়েছে ৪৭১টি শিল্পপ্লটের। অবশিষ্ট এলাকায় মাটি ভরাট কাজ চলমান।
সেখানে সড়ক, ড্রেন, বৈদ্যুতিক লাইন ও সাবস্টেশন, সৌরবিদ্যুৎ বাতি, পানির লাইন, ইফ্লুয়েন্ট নেটওয়ার্ক, গভীর নলকূপ, গ্যাস নেটওয়ার্ক স্থাপনের কাজ চলছে। এছাড়া একটি জোন সার্ভিসেস কমপ্লেক্স (বেপজার প্রশাসনিক ভবন), দুটি ডরমিটরি, একটি ইনভেন্টস ক্লাব, বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি ইনভেস্টরস আবাসিক ভবন, সিকিউরিটি ও কাস্টম ভবন, একটি প্রধান ফটক ও দুটি সিকিউরিটি/আনসার ব্যারাকের কাজ চলমান। এসব ভবন ও স্থাপনার কাজ চলতি বছরের জুনে শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সংশোধিত প্রকল্পে যা থাকছে
প্রকল্পের আওতায় নতুন করে আরও এক হাজার ১০ একর ভূমি উন্নয়ন, এক হাজার ১৩৮ দশমিক ৫৫ একর জমিতে সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ, এক হাজার ১৩৮ দশমিক ৫৫ একর জমিতে নর্দমা নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়া জোন সার্ভিসেস কমপ্লেক্স নির্মাণ ও ইনভেস্টরস ক্লাব এবং ইনভেস্টরস আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হবে। নতুন করে অফিসার্স ডরমিটরি ও স্টাফ ডরমিটরি, আবাসিক ভবন, দুটি কারখানা ভবন, মসজিদ, মেডিকেল সেন্টার, ফায়ার স্টেশন, হেলিপ্যাড ও কালভার্ট, সিকিউরিটি ও কাস্টম ভবন, সিকিউরিটি ব্যারাক, সীমানাপ্রাচীর, প্রধান ফটক ও কাস্টমস ফটক নির্মাণ করা হবে।
১১ কেভি এইচটি লাইন ও সাবস্টেশন, সোলার প্যানেল সাইট ও সিকিউরিটি লাইট, ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ও ডিস্ট্রিবিউশন নেটওয়ার্ক, ইফ্লুয়েন্ট নেটওয়ার্ক, টেলিফোন নেটওয়ার্ক, গভীর নলকূপ স্থাপন, ওয়াটার কালেকশন নেটওয়ার্ক ও গ্যাস নেটওয়ার্ক ইত্যাদি থাকবে।
দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা, পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, নতুন প্রযুক্তি স্থানান্তরের মাধ্যমে বাংলাদেশি নাগরিকদের কর্মদক্ষতা বাড়ানো হবে। অগ্রজ ও পশ্চাৎসংযোগ শিল্পকারখানা গড়ে তোলা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য হ্রাস তথা দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নও করা হবে প্রকল্পের মাধ্যমে।
পিএসএন/এমআই