কঠিন পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার অল্প সময়ের মধ্যে নীতিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।
এমন অবস্থায় জনগণের প্রত্যাশাও ‘আকাশচুম্বী’ মন্তব্য করে তিনি বলেছেন, “সবাই মনে করে যে আমাদের হাতে জাদুর চেরাগ আছে। আমরা চেরাগ ঘষে দিব। ব্যাস, সাথে-সাথে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আসলে বিষয়টা এমন না।“কারণ হচ্ছে, আমরা একটা কঠিন সময়ে দায়িত্ব নিয়েছি। যখন সরকারি কোষাগারে টাকা নাই, বৈদেশিক মুদ্রা নাই। এমন একটা পরিস্থিতিতে আমাদের দায়িত্ব নিতে হয়েছে। আমাদের হাতে সময় বেশি নাই। রাজনীতিবিদরাও ক্ষমতায় আসার জন্য উশখুশ করছেন।”
শনিবার ঢাকায় বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরামের (বিএসআরএফ) ‘সংস্কার ও টেকসই উন্নয়নের সমন্বয়ে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনারে কথা বলছিলেন খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা।তিনি বলেন, “সরকার যে একটা আমানত, এই কথাটা ভুলে গেছি। ফলে আমরা ব্যক্তিস্বার্থ, বন্ধুবান্ধবের স্বার্থ, আত্মীয়-স্বজনের স্বার্থ বাস্তবায়ন করেছি। ফলে মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়েছে। রাস্তায় নেমেছে।”
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার অল্প সময়ের মধ্যে নীতির সংস্কার এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারে কাজ করছে বলে জানান তিনি।বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত নিয়ে মানুষের অসন্তোষ রয়েছে জানিয়ে ফাওজুল কবির বলেন, “এই খাত নিয়ে জনগণের ভীষণ অসন্তোষ আছে। এখানকার দুর্নীতি নিয়ে। তারপরে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, গ্যাসের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি এগুলো নিয়ে অসন্তোষ আছে।“এজন্য আমরা প্রথমে যেটা করেছি, এই যে দুর্নীতি হয়েছে, দুর্নীতির অবকাঠামোটাকে সম্পূর্ণভাবে ভেঙে দিয়েছি। আমরা প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারও শুরু করেছি। যিনি জানেন এবং লোভের ঊর্ধ্বে উঠে সরকারকে আমানত মনে করেন, সেরকম লোকদের আমরা বিভিন্ন বোর্ডে দায়িত্ব দিচ্ছি।”
জ্বালানি সংকট সামাল দিতে ভোলায় গ্যাস কূপ খননের নির্দেশ দেওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “গতকাল (শুক্রবার) ভোলাতে গেছি। সেখানে গ্যাস কূপ খনন করা হবে। অলরেডি পাঁচটা কূপ খনন করার নির্দেশ দিয়েছি। আরও চার থেকে পাঁচটা কূপ খনন করার নির্দেশ দিয়েছি। (গ্যাস) পেলে এলএনজি আমদানি কমবে।“বিদেশি মুদ্রার যে সংকট, সেটা কাটিয়ে উঠতে পারব। উন্নয়ন পরিকল্পনার যে গ্যাপ, যেগুলোর কারণে মানুষ উন্নয়নের সুফল পায় না, সেগুলো আমরা পূরণ করার চেষ্টা করেছি।”
সরকারকে ‘আমানতদারী প্রতিষ্ঠান’ মনে না করায় বিভিন্ন প্রকল্পে ভুল বিশ্লেষণ হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এর ফলে প্রকল্পগুলো ‘লাভজনক ও জনকল্যাণমুখী হয়নি’৷তার ভাষ্য, “আর কোনো প্রকল্পের মেয়াদ বাড়বে না, প্রকল্পের ব্যয় বাড়বে না। আমরা চেষ্টা করছি, যেগুলো বাজে প্রকল্প, সেগুলোকে কেটে ছেঁটে বাদ দিতে। গণঅভুত্থ্যানের যে আকাঙ্ক্ষা, সে অনুযায়ী আমরা কাজ করতে চেষ্টা করছি।”
সেমিনারে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “কীসের বিনিময়ে বিগত সরকারের আমলে উন্নয়ন হয়েছিল? একটি ‘ভেস্টেড গ্রুপ’ গড়ে উঠেছিল, যারা প্রকল্প বাস্তবায়ন থেকে শুরু করে কর্মকর্তা, কর্মচারীদের ট্রান্সফার পর্যন্ত তাদের প্রচ্ছন্ন হাত ছিল।“এ জায়গা থেকে আমাদের বের হয়ে আসা দরকার বলে মনে করি। পাবলিক প্রকিউরমেন্ট সিস্টেমে বড়রকম ভূত ঢুকে বসে আছে। একটা নির্দিষ্ট কোম্পানি বা নির্দিষ্ট কয়েকটা কোম্পানি কাজগুলো পাচ্ছে।“সবচেয়ে বড় দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, কন্ট্রাক্টর প্রজেক্ট প্রপোজাল তৈরি করে দেয়, এরপর প্রকল্প নেওয়া হয়। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা আমরা করছি।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, “জনগণের আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে সংস্কার এবং আগের ভুল ত্রুটি থেকে শিক্ষা নিয়ে টেকসই উন্নয়ন করতে হবে। রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, হাওরের ওপর দিয়ে রাস্তা, দাশেরকান্দি পয়োঃবর্জ্য কেন্দ্রের পরিকল্পনাহীন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।“আমার বলেছি পরিকল্পনা কমিশনের মধ্যে একটা ইউনিট থাকবে, যারা শুধু যথাযথ প্রকল্পগুলো বাছাই করবে। সুনির্দিষ্ট দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নাই। ন্যাশনাল ফিজিক্যাল প্ল্যান বা ভৌত পরিকল্পনা নিলে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন হত না।”
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক এ কে এম আতিকুর রহমান।বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক (ডিজি) সরদার সাহাদাত আলী, বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক শারমিন্দ নীলোর্মি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলসেতু প্রকল্পের প্রধান আন্তর্জাতিক পরিবেশ বিশেষজ্ঞ মেহেদী এইচ ইমন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা ও মাহিন সরকার সেমিনারে বক্তব্য দেন।