ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় গত ছয় মাসের তুলনায় গত কিছুদিনে মশার উপদ্রব বেড়েছে কয়েক গুণ। বাসাবাড়ি, অফিস-আদালত সর্বত্রই মশার যন্ত্রণা। মশা এতটাই বেড়েছে যে কয়েল, স্প্রে, ইলেকট্রিক ব্যাট কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। কোথাও কোথাও দিনদুপুরেও মশা তাড়াতে কয়েল জ্বালিয়ে রাখতে হচ্ছে।
বাস-লেগুনায় বসেও যাত্রীরা মশা তাড়ায়।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, চলতি মার্চ মাসের শুরুতে মশার বৃদ্ধির হার বেড়েছে। এ মাসেই সেটি চার গুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে। স্বাভাবিকভাবে শীতে মশার উপদ্রব বাড়ে। সেটা সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে জাতীয় সমস্যায় রূপ নেয়। তাঁরা বলছেন, কিউলেক্স মশার কামড়ে বাংলাদেশের কিছু কিছু জায়গায় (দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও) ফাইলেরিয়া বা গোদ রোগ ছড়াতে দেখা যায়। একসময় এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি থাকলেও এখন কম। এই রোগে আক্রান্তদের পা ফুলে যেতে দেখা যায়। যদিও এটি রাজধানী বা এর আশপাশে এখনো দেখা যায়নি।
সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি মাসে কিউলেক্স মশা বাড়বে চার গুণ। রাজধানীতে গত বছরের তুলনায় এই বছরের মার্চের শুরুতে মশার ঘনত্ব বেড়েছে। চলতি মাসজুড়ে ঘনত্ব আরো বাড়বে। মশার খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয় ড্রেন, নর্দমার পচা পানি। যখন শীতের পরে তাপমাত্রা বাড়ে, তখন মশার জীবনচক্র বেড়ে যায়। জীবনচক্রের গতিশীলতা বেড়ে যায়। এই সময়ে মশা ডিম বেশি পাড়ে। এসব কারণে মশা বাড়বে এবং বাড়ছে। গবেষণার জন্য বেছে নেওয়া হয় রাজধানীর উত্তরা, গুলশান, মোহাম্মদপুর, খিলগাঁও, কাঁঠালবাগান এবং পুরান ঢাকার সদরঘাটকে। এতে দেখা যায়, ঢাকার চারদিকে নিচু অঞ্চলগুলোতে মশার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘এখন যে মশা আছে সেগুলো কিউলেক্স মশা। এই মশা ড্রেন বা নর্দমার পচা পানিতে হয়। এডিস মশার মতো নয়। এডিস মশা পাত্রে জমা পানিতে হয়। আর কিউলেক্স নর্দমার পচা পানিতে হচ্ছে। তাই শুরুতেই ড্রেন-নর্দমা পরিষ্কার করতে হবে। তারপর মশার লার্ভা মারার জন্য কীটনাশক দিতে হবে। অবশ্যই পানিতে থাকা কচুরিপানা বা ময়লা-আবর্জনা সরাতে হবে। একই জায়গায় এক সপ্তাহ পর পর লার্ভিসাইড করতে পারলে মশা নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। আর উড়ন্ত মশা মারার জন্য ফগিং করতে হবে। ’
কবিরুল বাশার বলেন, ‘টেকসই সমাধান পেতে সবার আগে প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস করে মশা মারতে পরীক্ষিত ও কার্যকর ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। ’
কিউলেক্স মশা যখন বাড়ছে, তখন এডিস মশা নিয়েও সচেতন থাকতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নির্ণয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও সাবেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মোস্তাক হোসেন বলেন, ‘ঢাকায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী সব সময়ই পাওয়া যাচ্ছে। এবার শীতকালেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। সে কারণে এখন এডিস মশা নেই, সেটি বলা যাবে না। ’
সরেজমিন চিত্র : গত শুক্রবার সন্ধা সাড়ে ৬টার দিকে গুলিস্তান যাওয়ার উদ্দেশ্যে আজিমপুর মোড়ে লেগুনায় চড়ে বসেন আফসানা নুর কেয়া নামে ইডেন মহিলা কলেজের এক শিক্ষার্থী। যাত্রীর জন্য অপেক্ষমাণ যানটিতে কেয়া বারবার মশা তাড়াচ্ছিলেন আর বিরক্তির সঙ্গে চালককে বারবার লেগুনা ছাড়তে বলছিলেন। কেয়া বলেন, ‘একটা সেকেন্ড মশার জন্য বসতে পারছি না। এখানে যে অবস্থা, আমাদের কলতাবাজারের (পুরান ঢাকা) বাসায় একই অবস্থা। নিচতলায় থাকি, মশার সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হচ্ছে। ’
মশার এমন উপদ্রব দেখা যায় লালবাগ এলাকার শহীদনগর, কেল্লার মোড়, কামরাঙ্গীর চরসহ আশপাশের এলাকায়ও। তবে এ পরিস্থিতি স্বীকার করলেন না দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির। তিনি বলেন, ‘অন্য জায়গার কথা বলতে পারি না, দক্ষিণ সিটিতে মশা পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এর পরও কোনো এলাকা থেকে অভিযোগ এলে বিশেষ অভিযান চালাচ্ছি। যদিও আমাদের কাছে অভিযোগ নেই বললেই চলে। ’
লালবাগ, আজিমপুরসহ পুরান ঢাকায় মশার উপদ্রবে বাসিন্দারা অতিষ্ঠ—এ কথা তাঁকে জানালে শামসুল কবির বলেন, ‘এসব এলাকা থেকে কোনো অভিযোগই আসেনি। দু-একটি জায়গা থেকে বিচ্ছিন্নভাবে অভিযোগ আসার পর আমরা বিশেষ অভিযান চালিয়েছি। আমরা গত ১ জানুয়ারি থেকে জলাশয় তথা খাল পরিষ্কার শুরু করি, এখন পরিষ্কার কার্যক্রম প্রায় শেষ পর্যায়ে। ’
মশা বাড়তে থাকায় অতিষ্ঠ ঢাকা উত্তর সিটির বাসিন্দারাও। বাড্ডা, রামপুরা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি এলাকার মানুষ মশার বৃদ্ধি নিয়ে সমস্যার কথা জানাচ্ছে। রামপুরা সেতুর পাশে বসবাসকারী মাহমুদ আহমেদ বলেন, ‘সাততলা একটি বাসার ছয় তলায় থাকি, তবু মশার যন্ত্রণা থেকে নিস্তার নেই। সিটি করপোরেশন কাজ করে বললেও সেই কাজের ফল আমরা পাচ্ছি না। ’ গুলশান, বনানী, বারিধারা এলাকা লেক দিয়ে ঘেরা হওয়ায় এসব এলাকায়ও মশা বাড়ছে। লেকগুলোতে ময়লা-আবর্জনা থাকাকে দায়ী করছে এলাকাবাসী।
আফতাব আহমেদ নামে গুলশান ১-এর বাসিন্দা বলেন, ‘সুন্দর লেকগুলো ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না। এতে মশার ওষুধ দিলেও তা কাজ করে না। ’ এসব বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘উত্তরের বিভিন্ন এলাকায় মশা বাড়ার অভিযোগ আসছে। আমরা খুব দ্রুত অভিযান চালাব। এ ছাড়া নিয়মিত কাজগুলো করা হচ্ছে। ’
মশার উপদ্রব বাড়ছে শাহজালালে : হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মশার উপদ্রব বাড়ছেই। বিমানবন্দরের আশপাশের এলাকা থেকে মশা বেশি আলোকিত বিমানবন্দর এলাকায় চলে আসে বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। বেবিচক মশা নিধনে লার্ভা ধ্বংসকরণ, পতিত জমি ও জলাশয়ের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি নিশ্চিত করছে। বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের নির্মাণকাজের জন্য এয়ার ও ল্যান্ড সাইডের ডোবা বা জলাশয়গুলো ভরাট করা হয়েছে। তবু বাগে আসছে না মশার উৎপাত। মশা তাড়াতে ‘ধূপ কামান’ ব্যবহার করেছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। শাহজালালে মশার হাত থেকে বাঁচতে কয়েল জ্বালিয়ে স্বজনদের যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায়।
বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ এইচ এম তৌহিদ-উল আহসান বলেন, ‘আমরা সারা বছর মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করছি। ঝোপ ও নালা পরিষ্কার করি, মশার লার্ভা নিধন করি। সকালে লার্ভিসাইড, বিকেলে ইনসেক্টিসাইড দেওয়া হয় ফগিং মেশিন দিয়ে। টার্মিনালের প্রতিটি গেটে ধূপ দেওয়া হচ্ছে। ’ তিনি আরো বলেন, বিমানবন্দরের আশপাশের তিন-চার কিলোমিটার এলাকা থেকে মশা বেশি আসে। বিমানবন্দরের ভেতরে মশার কোনো উৎপত্তিস্থল নেই।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় মশার উপদ্রব রোধে অবিলম্বে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সম্প্রতি নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একটি রিট আবেদনের শুনানির সময় বেবিচক চেয়ারম্যানকে এ বিষয়ে ১০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়।
পিএসএন/এমঅাই