সভ্যতা আর সংস্কৃতির উন্নয়নে অনেক পেশাই আজ খুঁজে পাওয়া যায় না। আমরা সবাই জানি কম্পিউটারের ব্যবহার বিকাশের সাথে সাথে হারিয়ে গেছে টাইপ রাইটার পেশাটি। কিন্তু আমরা কি জানি ভিস্তিওয়ালা পেশাটির কথা। আজ আপনাদের জানাবো ভিস্তিওয়ালা পেশাটি কী আর কেনই বা তা হারিয়ে গেল কালের বিবর্তনে।
পানি সরবরাহকারী এই সম্প্রদায়টি কারো কাছে ‘ভিস্তি’, আবার কারো কাছে ‘ভিস্তিওয়ালা’ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এই ‘ভিস্তি’ নামটি কীভাবে এসেছে তা নিয়ে প্রচলিত আছে নানা মত। ধারণা করা হয়, ‘ভিস্তি’ শব্দটি এসেছে ফারসি শব্দ ‘বেহেশত’ থেকে, যার অর্থ ‘স্বর্গ’।
দ্য লাস্ট ওয়াটার ম্যান বলে খ্যাত বিশেষ এক পেশার নাম ভিস্তি। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত ঢাকার রাস্তায় ভিস্তিদের আনাগোনা ছিল । ঢাকায় ভিস্তিওয়ালাদের বলা হতো ‘সাক্কা’। পুরান ঢাকার সিক্কাটুলি ছিল সে সময়ের ভিস্তিদের এলাকা। তাদের একটি সংগঠন ছিল যার প্রধানকে নওয়াব ভিস্তি বলা হতো। ১৮৩০ সালের এক আদমশুমারিতে সে সময়কার ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট হেনরি ওয়াল্টারস ভিস্তিদের ১০টি পল্লীর কথা উল্লেখ করেন। বিশেষ এ পেশাজীবী শ্রেণিদের মধ্যে নিজস্ব পঞ্চায়েত ব্যবস্থাও প্রচলিত ছিল।
ভিস্তিওয়ালারা বাড়ি বাড়ি পানি দেওয়ার কাজে নিয়োজিত ছিল। সেসময় ভারতবর্ষের অন্য অঞ্চলের মতো ঢাকায়ও নিরাপদ পানির জন্য শহরবাসীদের অনেক দূর দুরান্তে ঘুরে বেড়াতে হতো। নিরাপদ পানির প্রাকৃতিক উৎস তখন ছিল শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা নদী। এছাড়াও খাল, নদী বা কুয়ার যে উৎস রয়েছে তা থেকে সুপেয় পানি সংরক্ষণ করাটা ছিল অনেক কষ্টসাধ্য। আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী লোকেরা তাই অর্থের বিনিময়ে লোকদের দিয়ে নিজেদের পানি সংগ্রহ করতেন। বাড়ি বাড়ি পানি দেওয়ার এই বিশেষ পেশাজীবীর নামই হলো ভিস্তি বা সুক্কা।
ভিস্তিওয়ালাদের কাঁধে ঝুলানো থাকতো ছাগলের চামড়ার বড় ব্যাগ বা থলে। এই থলে দিয়েই টাকার বিনিময়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তারা পানি সরবরাহ করতো। লালবাগ কেল্লায় ভিস্তিরা টমটম ভরে বড় বড় চামড়ার থলেতে পানি দিয়ে আসতো। তারা ইসলাম ধর্মের অনুসারী, যার অধিকাংশই ছিল সুন্নি মুসলিম। তাই মহররমের মিছিলে রাস্তায় পানি ছিটিয়ে পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব ছিল তাদের। ঢাকার রাস্তায় ভিস্তিদের দেখতে পাওয়া যেত বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত।
মোঘল সম্রাটের ইতিহাস ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুকুমার রায়, শামসুর রাহমানের লেখায় ভিস্তিদের অস্তিত্বের প্রমান পাওয়া যায় ৷ পানি সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ার সাথে সাথে ভিস্তিওয়ালা নামে এই পেশাটি হারিয়ে যেতে থাকে। ভারতবর্ষের মধ্যে একমাত্র ঢাকাতেই এই পেশা বেশি সময় পর্যন্ত টিকে ছিল। ১৯৬৮ সালের দিকে ঢাকা থেকে পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায় এই পেশাটি।
নিজাম ভিস্তিওয়ালা
১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দ; শের খান বিহারসহ মুঘল অঞ্চলগুলো জয় করে কনৌজের দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। এদিকে বাংলা জয় করে মুঘল সম্রাট হুমায়ুন চলেছেন রাজধানী আগ্রা অভিমুখে। এরইমধ্যে যাত্রাপথে চৌসা নামক স্থানে শের খানের বিশাল বাহিনীর আক্রমণের শিকার হন হুমায়ুন। চলছে পরস্পর যুদ্ধের মহড়া।
২৬ জুন ১৫৩৯; নীরব, নিস্তব্ধ তাঁবুতে বিশ্রাম নিচ্ছে সম্রাটের বাহিনী। আচমকা কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই তাঁবুতে হানা দেয় শের খানের বাহিনী। তার দূরদর্শিতার কাছে হার মানে মুঘল বাহিনী। দিগ্বিদিক না ভেবেই মুঘল সম্রাট ঝাঁপ দিলেন গঙ্গায়। সম্রাট নদীতে প্রায় ডুবু ডুবু, ঠিক এই সময় ত্রাণকর্তারূপে হাজির ভিস্তিওয়ালা নিজাম। সম্রাটের দিকে তিনি ছুড়ে দিলেন তার বাতাস ভর্তি মশক। নিজামের এই মশকে ভর করেই হুমায়ুন পাড়ি দিলেন গঙ্গা। বেঁচে গেলেন হতভাগ্য সম্রাট। সেদিন হুমায়ুন ভিস্তিওয়ালাকে কৃতজ্ঞচিত্তে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে পারলে একদিনের জন্য হলেও মসনদে বসাবেন তাকে।
হুমায়ুন রাজ্য পুনরুদ্ধার করলেন। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, সম্রাট স্বীয় প্রতিশ্রুতি রাখলেন। নিজাম ভিস্তিওয়ালাকে বসালেন আগ্রার মসনদে। শুরু হয় নিজামের একদিনের শাসন। নিজাম তার মশককে ছোট ছোট টুকরো করে কেটে সেগুলোতে সিল্ক ও স্ট্যাম্প লাগালেন। সেসব স্ট্যাম্পে তার নাম এবং রাজ্য অভিষেকের তারিখ লিপিবদ্ধ করে মুদ্রা জারি করেন। এভাবেই একজন ভিস্তিওয়ালা তার একদিনের সাম্রাজ্য শাসন স্মরণীয় করে রাখেন।
সেই সময় থেকে মুঘল সম্রাটের জীবন বাঁচানোর জন্য ভিস্তিওয়ালারা ইতিহাসে সুপরিচিত। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত ভিস্তিওয়ালারা ছিল ঢাকার রাস্তায়।