ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাস বলছে, এখন পর্যন্ত জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী এবং নরেন্দ্র মোদি ছাড়া মনমোহন সিংই দীর্ঘতম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী পদে ছিলেন। সামলেছেন রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর, যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান, রাজ্যসভায় বিরোধী দলনেতার পদও।
শিক্ষায় আর পেশায় অর্থনীতিবিদ মনমোহন সিং রাজনীতির ময়দানে পরিচিত হন ১৯৯১ সালে, ভারতের অর্থমন্ত্রী হিসেবে। সেই সময়ে ভারতের অর্থনীতির ভয়াবহ অবস্থা হয়েছিল। হঠাৎ করেই মন্ত্রী হওয়ার আগে তিনি একসময়ে ছিলেন সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা আর ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার গভর্নর। এখনও এমন ভারতীয় নোট দেখতে পাওয়া যায়, যদিও খুবই কম, যেখানে রিজার্ভ ব্যাংকের নোটে তার সই থাকত গভর্নর হিসেবে। একটা সময়ে রিজার্ভ ব্যাংকের আঞ্চলিক প্রধান হিসেবে কলকাতাতেও কাজ করেছেন তিনি।
নরসিমা রাওয়ের মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পরে তাঁর প্রথম ভাষণে তিনি ভিক্টর হুগোর বিখ্যাত উক্তি উদ্ধৃত করে বলেছিলেন– যদি একটি ভাবনার আসার সময় হয়ে গিয়ে থাকে, তাকে পৃথিবীর কোনো শক্তিই আটকাতে পারে না। সেটিই ছিল ভারতের এক উচ্চাভিলাষী এবং অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক সংস্কারের শুরুর ইঙ্গিত। এরপরই শুরু হয় করের হার কমানো, ভারতীয় টাকার অবমূল্যায়ন, সরকারি সংস্থাগুলোর বেসরকারীকরণ আর বিদেশি বিনিয়োগে উৎসাহ দেওয়ার মতো কর্মসূচিগুলো। তার সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী অর্থনীতি সত্যিই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে, মূল্যবৃদ্ধি রোধ করা সম্ভব হয় আর গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে প্রবৃদ্ধির হার লাগাতার উঁচুর দিকেই থাকে।
তাঁর কথায়, একজন রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠা যায়, কিন্তু সেটা হতে হলে তো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোটে জিততে হবে। ভারতের সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভার ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন ১৯৯৯ সালে। কিন্তু হেরে যান তিনি। এরপর উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার সংসদ সদস্য হয়েছিলেন আসাম থেকে। এরপর এলো ২০০৪ সালের নির্বাচন। কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল, কিন্তু কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী প্রধানমন্ত্রী পদ নিতে অস্বীকার করলেন।
সমালোচকরা সে সময় বলেছিলেন, মনমোহন সিংয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়কালে সোনিয়া গান্ধীই ছিলেন আসল ক্ষমতার উৎস। তাঁর নিজের কোনো ক্ষমতাই ছিল না। তবে সমালোচনার জবাব মুখবুজেই দিয়েছেন ভারতীয় রাজনীতির বিরল এ ব্যক্তিত্ব।
তাঁর প্রয়াণের পর সেই সমালোচকরাও আজ স্বীকার করছেন, আধুনিক ভারতের অর্থনৈতিক উদারীকরণের জনক তিনিই। ভারত আজ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যেটুকু সম্ভ্রম আদায় করতে পেরেছে, তার কৃতিত্ব মনমোহন সিংকেই দিতে হবে।
বিজেপি নেতৃত্ব তাঁর মিতভাষী স্বভাবকে কটাক্ষ করে বার বার ‘মৌনীমোহন’ বা ‘দুর্বল প্রধানমন্ত্রী’ বললেও দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘সিং ইজ কিং’। আর্থিক সংস্কারের পাশাপাশি গরিব জনগোষ্ঠীর সামাজিক সুরক্ষা সুনিশ্চিত করার বিষয়টিকেও মনমোহন নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প তাঁর সরকারেরই অবদান। ভারতের ইতিহাসে মনমোহনই একমাত্র প্রধানমন্ত্রী, যিনি আগে নিজের অবসরের কথা ঘোষণা করেছিলেন। খবর বিবিসির