রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকটের বড় ধাক্কা লেগেছে দেশের অর্থনীতিতে। মুদ্রার বিনিময় হারে চলছে অস্থিরতা। দেশের অর্থনীতিতে এখন বড় তিন সমস্যা ডলার সংকট, জ্বালানি ঘাটতি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানি ব্যয় বেড়েছে। এতে চাপে পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ফলে ধারাবাহিকভাবে কমছে রিজার্ভ। বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান দুই উৎস রপ্তানি ও রেমিট্যান্সও কমছে। ফলে চাপমুক্ত হতে পারছে না বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।
যেভাবে রিজার্ভ কমছে, তা অব্যাহত থাকলে চাপ বাড়বে সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর। সর্বশেষ মন্ত্রিসভার বৈঠকে আগামী বছরে সংকট আরও তীব্র হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়েছে। এ অবস্থায় অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের অর্থনীতি এখন বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। সংকট উত্তরণে চাই বহুমুখী ও সমন্বিত পদক্ষেপ। এজন্য সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে উচ্চপর্যায়ের কমিটি করে উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে।
তবে আশার বাণী শুনিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। গতকাল স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে বাংলাদেশের উত্তরণ নিয়ে রাজধানীর হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় সেমিনারে তিনি বলেন, ডিসেম্বরে মুদ্রা পরিস্থিতি স্বভাবিক হতে শুরু করবে। আগামী জানুয়ারির মধ্যে ডলারের সংকট কেটে যাবে। হুন্ডি প্রতিরোধে রয়েছে কঠোর নজরদারি।
তিনি বলেন, ‘চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে অস্বাভাবিকভাবে এলসি খোলা হয়েছে। এটি আমরা কমিয়েছি। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট নেই। তবে দেশে আন্ডার ইনভয়েসিং (কম মূল্য দেখানো) ঠেকাতে আমরা সতর্ক অবস্থান নিয়েছি।’
সাম্প্রতিক তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দেশের মূল্যস্ফীতি প্রতিবেশী দেশের তুলনায় অনেক বেশি। সরকারি হিসেবে পরপর ২ মাস ৯ শতাংশের উপরে থাকার পর অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৯১ শতাংশে। সেপ্টেম্বরে এ হার ছিল ৯ দশমিক ১০ ও আগস্টে ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে। গতকাল ফের তেল ও চিনির দাম বাড়ানো হয়েছে। সামনে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হতে পারে। ফলে সামনের দিনগুলোতে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ থাকবে। তবে মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে সরকারি তথ্য নিয়েও বিতর্ক আছে। অনেকে মনে করেন, প্রকৃত মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি।
মূল্যস্ফীতি বাড়ার অন্যতম কারণ বলা হচ্ছে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি এবং আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া। বিশেষ করে সংকটের কারণে ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অবস্থায় বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান উৎস রপ্তানি সেপ্টেম্বর থেকে কমছে। অক্টোবরে ৪৩৫ কোটি ৬৬ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ কম। অবশ্য অর্থবছরের প্রথম চার মাসের (জুলাই-অক্টোবর) হিসাবে সার্বিকভাবে পণ্য রপ্তানি এখনো গত বছরের চেয়ে বেশি আছে। এই চার মাসে ১ হাজার ৬৮৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়, প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ।
ইপিবির হিসাব বলছে, অক্টোবরে রপ্তানি আয় গত বছরের একই মাসের তুলনায় কমেছে প্রায় ৮ শতাংশ। কমার এই প্রবণতা শুরু হয় গত সেপ্টেম্বরে। এর আগে টানা ১৩ মাস রপ্তানি আয় বেড়েছিল। অবশ্য সেপ্টেম্বরের সঙ্গে অক্টোবরের তুলনা করলে দেখা যায়, রপ্তানি আয় বেড়েছে সাড়ে ১১ শতাংশ।
অন্যদিকে, অক্টোবর মাসে যে পরিমাণ প্রবাসী আয় এসেছে তা গত আট মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এই আয় গত বছরের অক্টোবরের তুলনায় ৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ কম। ডলারের দাম বেঁধে দেওয়ার পর থেকেই প্রবাসী আয় কমতে থাকে। গত অক্টোবরে প্রবাসীরা ১৫২ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠিয়েছেন, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ কম। সেপ্টেম্বরে কমেছিল ১০ শতাংশের বেশি।
চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাস মিলিয়ে প্রবাসী আয় এসেছে ৭২০ কোটি ডলারের মতো, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় মাত্র ২ শতাংশ বেশি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ডলারের দাম নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো একের পর এক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এতে প্রবাসী আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
রাজস্ব আয়েও নেতিবাচক ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নানাবিধ সংকটের মুখে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রাজস্ব আয় কমেছে ৫ হাজার ৫১৯ কোটি টাকা। তবে এ সময় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ৬৩ শতাংশ। অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বরে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭১ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ৬৫ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের (২০২১-২২) একই সময়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে রাজস্ব আসে ৫৮ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা।
এই অবস্থায় বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেছেন, বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটে বড় শঙ্কার বিষয় হচ্ছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও খাদ্য নিরাপত্তায় ঝুঁঁকি। গত ফেব্রুয়ারি থেকে মূল্যস্ফীতি ৬ থেকে সাড়ে ৯ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। বাস্তবে মূল্যস্ফীতি আরও বেশি। তবে কমিয়ে দেখানো হচ্ছে বলে বিতর্কও আছে। অথচ ভিয়েতনাম, ভারত ও ইন্দোনেশিয়ায় মূল্যস্ফীতির হার বাংলাদেশের চেয়ে কম। গত অক্টোবরে মূল্যস্ফীতির হার ভারতে ৬ দশমিক ৭৭, ইন্দোনেশিয়ায় ৫ দশমিক ৭১ এবং ভিয়েতনামে ৪ দশমিক ৩০ শতাংশ। আর বাংলাদেশে ছিল ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ।
সেলিম রায়হান বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও প্রকৃত মজুরি কমে যাওয়ায় খাদ্য নিরাপত্তায় ঝুঁঁকি তৈরি হয়েছে। গত ১১ মাসে রিজার্ভ গড়ে ১০০ কোটি ডলার কমেছে। রপ্তানি ও প্রবাসী আয়েও সামনের দিনে সুখবর নেই। তবে পণ্য আমদানির ঋণপত্র কমেছে। তার মধ্যে মূলধনী যন্ত্রপাতি ও মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ায় চলতি অর্থবছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান কমবে। বিদেশি ঋণের কাঠামোও পরিবর্তন হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় না বাড়লে কয়েক বছর পর এই ঋণ পরিশোধের জন্য অর্থনীতিতে বাড়তি চাপ তৈরি হবে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ২০২৩ সালে সারাবিশ্বের জন্য কঠিন সময় যাবে। সেই সূত্রে বাংলাদেশের জন্যও কঠিন যাবে। বিশেষ করে দেশের অর্থনীতিতে ডলার সংকট এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে কোনোভাবেই উল্টোপথে যাওয়া যাবে না। সমাধান করতে গিয়ে বিপরীতমুখী পদক্ষেপ না নেওয়ার পরামর্শও দেন তিনি। তেল আমদানি কমিয়ে যতটা সাশ্রয় হয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানোয় তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। সংকটকালীন সময়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ডলার সংকট কাটাতে বিনিময় হার বাজারমূল্যের সাথে সমন্বয় করতে হবে, যাতে করে হুন্ডির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে। এ ছাড়া সুদের হারে ক্যাপ তুলে দেওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, সামনে বিদ্যুতের দাম বাড়ালে মূল্যস্ফীতির ওপর আরও চাপ বাড়বে।
সার্বিক পরিস্থিতিতে সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হানের পরামর্শ, বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণে স্বল্প মেয়াদে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। আওতা বাড়াতে হবে। কারণ অনেকেই নতুন করে খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিতে পড়বে। রিজার্ভের পতন ঠেকাতে হবে। আর মধ্যমেয়াদে রাজস্ব ও ব্যাংক খাতে সংস্কার আনতে সরকারের সদিচ্ছা লাগবে। তা ছাড়া বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে উচ্চপর্যায়ের কমিটি করা দরকার। সেই কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
পিএসএন/এমঅাই