সুখ আর স্বাচ্ছন্দ্যেই চলছিলো জোবাইদার সংসার। গত বছর ছেলেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করেছেন আর মেয়েটি কেবল অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। ২৭ বছরের সংসারজীবনে স্বামী আর দুই সন্তানই তাঁর ভাবনার জগৎ জুড়ে থাকে। স্বামী শাহেদ আকবর উপজেলা সদরে ওষুধের দোকান চালান। তিনি সকালের খাবার খেয়ে দোকানের উদ্দেশ্যে বের হন, দুপুরে বাড়িতে এসে খাবার খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে আবার বিকেলে দোকান খোলেন। ব্যবসার ফাঁকেই গ্রামের জমিজমা দেখাশোনা করেন তিনি। খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার প্রত্যন্ত একটি গ্রামে পরিবারটির বাস।
পরিবারটির স্বাভাবিক জীবনযাপনে হঠাৎ ছন্দপতন হয়। কিছুটা অসুস্থ হয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তারের কাছে যান জোবাইদা। সমস্যার কথা শুনে ডাক্তার পেপস টেস্ট করার জন্য বলেন। পরীক্ষায় প্রাথমিকভাবে জোবাইদার জরায়ুমুখ ক্যান্সার শনাক্ত হয়। পরে জরায়ুমুখ হতে নমুনা নিয়ে বয়োপসি পরীক্ষার মাধ্যমে তার শরীরে ক্যান্সারের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়। এবার ঢাকায় জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য যান তিনি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জানালেন অপারেশন করে শরীর থেকে জরায়ু অপসারণ করলেও সুস্থতা নিয়ে খুব একটা আশাবাদী হওয়ার উপায় নেই। ততদিনে ক্যান্সার নামক রোগটি তার জরায়ুপথ, মূত্রনালি, পায়ুপথ সংলগ্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে, একইসাথে কিডনির কার্যকারিতা হ্রাস পেয়ে শারীরিক অবস্থারও হয়েছে অবনতি। কয়েক মাস ধরে চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ চেষ্টা সত্তে¡ও তার জীবনরক্ষা হলো না। অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে মৃত্যুর কাছে হার মানলেন জোবাইদা।
প্রতিবছর বাংলাদেশে জোবাইদার মতো প্রায় চার হাজার ৯৭১ জন হতভাগ্য নারী জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। কাতালান ইনস্টিটিউট অব অনকোলজি এবং ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার এর যৌথ প্রয়াসে স্পেনে গড়ে ওঠা এইচপিভি-ইনফরমেশন সেন্টারের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্তের হার বেড়েই চলেছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে এই ক্যান্সারে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নারী প্রাণ হারান। দেশে প্রতি এক লাখ নারীর মধ্যে ১১ জন এরোগে আক্রান্ত হন। মনে রাখা দরকার, এই ক্যান্সারের চিকিৎসাও অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং চিকিৎসা নিয়ে নিরাময়ের সম্ভাবনাও কম।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অধীন পরিচালিত ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সারের ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৈশ্বিকভাবে সাধারণত নারীরা যেসকল ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন তার মধ্যে জরায়ুমুখ বা সার্ভিক্যাল ক্যান্সার চতুর্থ সর্বোচ্চ। প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ছয় লাখের বেশি নারী এরোগে আক্রান্ত হন, যার মধ্যে প্রায় তিন লাখ নারীই মৃত্যুবরণ করেন। এই ক্যান্সারে আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনার প্রায় ৯০ শতাংশই আবার বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে হয়ে থাকে। ধারণা করা হচ্ছে, জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সফলভাবে বাস্তবায়িত না হলে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিবছর বিশে^ প্রায় সাত লাখ নারী এরোগে আক্রান্ত হবেন। আক্রান্ত এসকল নারীদের প্রায় চার লাখ অকালে মৃত্যুবরণ করবেন। এই মৃত্যুর সিংহভাগই ঘটবে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, কিশোরীদের এক ডোজ হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি) এর টিকা দেওয়ার মাধ্যমে ভবিষ্যতে তাদের জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমানো সম্ভব।
তাই বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে এই ক্যান্সার প্রতিরোধে কিশোরীদের বিনামূল্যে এইচপিভি টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জাতীয় এইচপিভি টিকাদান ক্যাম্পেইন ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসের ২৪ তারিখে শুরু হয়ে চার সপ্তাহ ধরে চলবে। গতবছর ঢাকা বিভাগের ১৫ লাখ আট হাজার ১৮৩ কিশোরীকে এইচপিভি টিকা দেওয়া হয়েছে। তাই এ বছর ঢাকা বিভাগে এই টিকাদান ক্যাম্পেইন পরিচালিত হবে না। এ বছর ঢাকা বিভাগ ব্যতীত খুলনাসহ অন্য সাতটি বিভাগের ৫১টি জেলায় (সিটি কর্পোরেশন-পৌরসভা এলাকাসহ) বসবাসরত পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণিতে পড়–য়া ছাত্রী অথবা ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বহির্ভূত কিশোরীদের এইচপিভি এর টিকা বিনামূল্যে প্রদান করা হবে।
আসন্ন ক্যাম্পেইনে মোট ৬২ লাখ ১২ হাজার ৫৫৯ কিশোরীকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে সরকার। এর মধ্যে বিদ্যালয়ের বাইরে থাকা এক লাখ ৮৬ হাজার ৬৭৬ কিশোরীকেও টিকা দেওয়া হবে। নির্দিষ্ট বয়সী ও নির্ধারিত শ্রেণিতে অধ্যয়নরত কিশোরীরা িি.িাধীবঢ়র.মড়া.নফ ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করে টিকাকার্ড সংগ্রহ করতে পারবে। পরে ঐ কার্ড দেখিয়ে টিকার ডোজ গ্রহণ করা যাবে। নিবন্ধনের জন্য ১৭ ডিজিটের জন্মনিবন্ধন নম্বর দেওয়া বাধ্যতামূলক। তবে যাদের হাতে লেখা পুরোনো জন্মসনদ রয়েছে বা যাদের জন্মসনদ নেই, তাদেরও বিশেষভাবে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। আগামী বছর থেকে ইপিআই কর্মসূচির আওতায় এই টিকাদান একটি নিয়মিত কার্যক্রম হয়ে যাবে। তখন স্কুলের ক্ষেত্রে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়–য়া ছাত্রীরা ও স্কুলের বাইরে যাদের বয়স ১০ বছর হবে, কেবল তারাই সরকারিভাবে বিনামূল্যে এই টিকা পাবে। এইচপিভি টিকায় উল্লেখযোগ্য কোন পার্শ^প্রতিক্রিয়া নেই। জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধে এইচপিভি টিকার একটি ডোজই যথেষ্ট। এই টিকা পরীক্ষিত, নিরাপদ ও কার্যকর। বিশে^ প্রচলিত এইচপিভি টিকাগুলোর মধ্যে আমাদের দেশের কিশোরীদের জন্য বেছে নেয়া টিকাটি কেবল এক ডোজের। যেটি ইনজেকশনের মাধ্যমে হাতের উপরের বহিরাংশের মাংশপেশীতে দেয়া হবে। ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী বিদ্যালয়ে পড়ুয়া কিশোরীদের সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়েই নির্দিষ্ট দিনে টিকাদানের ব্যবস্থা করা হবে। আর যারা বিদ্যালয়ে যায় না তাদের ইপিআই এর সেশন প্ল্যান অনুযায়ী টিকাদান কেন্দ্রে টিকা দেয়া হবে।
হিউম্যান প্যাপিলোমা একটি যৌনবাহিত ভাইরাস যা জরায়ুমুখ ক্যান্সার সৃষ্টি করে। এপর্যন্ত শনাক্ত হওয়া শতাধিক ধরণের এইচপিভি ভাইরাসের মধ্যে প্রায় ১৩টি সেরোটাইপ ক্যান্সার সৃষ্টির জন্য দায়ী। এদের মধ্যে ১৬ এবং ১৮ সেরোটাইপ খুবই মারাত্মক, যা ৭০ শতাংশ জরায়ুমুখ ক্যান্সারের কারণ হয়ে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এইচপিভি ভাইরাস সংক্রমণের লক্ষণ সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যায় না। সাধারণত এই ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার পর থেকে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের লক্ষণ প্রকাশ পেতে ১৫ থেকে ২০ বছর সময় লাগে। তবে স্বল্প রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন নারীদের ক্ষেত্রে এটি ক্যান্সারে রূপ নিতে মাত্র পাঁচ থেকে ১০ বছর সময় লাগতে পারে। যে সকল নারী প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে সচেতন নন তাদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এছাড়া বাল্যবিবাহ, ঘন ঘন সন্তান প্রসব, একাধিক যৌনসঙ্গী রাখা, ধূমপায়ী ও স্বল্প রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন নারীদেরও এরোগের ঝুঁকি অধিক।
আবার ফিরে যাই সেই জোবাইদার পরিবারে। মায়ের মৃত্যুর শোক কাটিয়ে চার মাস আগে বিশ^বিদ্যালয়ে ফিরে গেছে ছেলেটি। মেয়েটিকে আর চোখের আড়াল করেন না বাবা শাহেদ। প্রতিদিন স্কুলে পৌঁছে দেন সাইকেলে করে, ক্লাস শেষে নিয়েও আসেন বাড়িতে। গতপরশু স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিজেই শাহেদ কে জানান, অক্টোবর মাসের ২৪ তারিখ থেকে সরকারিভাবে বিনামূল্যে পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণিতে পড়–য়া সকল ছাত্রীকে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস প্রতিরোধী টিকা দেয়া হবে। এ টিকা নিলে সারাজীবনের জন্য জরায়ুমুখ ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। কথাগুলো শুনে উদাসদৃষ্টিতে কি যেনো ভাবলেন তিনি। টিকা নেয়ার রেজিস্ট্রেশনের পদ্ধতি জেনে তখনি মোবাইল ফোনে মেয়ের জন্য নিবন্ধন সেরে ফেললেন। মনে মনে বললেন, একই ভুল একজীবনে দুইবার নয়।
লেখক: মোঃ আতিকুর রহমান মুফতি, সহকারী তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, খুলনা